খেলাধুলা

এভাবে কেন ব্যাটসম্যানদের আত্মহত্যা?

খেলায় হারজিত থাকবেই। এটা খেলারই অংশ, নিয়ম। পরাজয় না মানার মানসিকতা নিয়ে কোনো দল খেলতে নামে না। তবে, একটা সাধারণ নিয়ম থাকে খেলায়। বড় দল, ছোট দল। বড় দলগুলোই অধিকাংশ সময় জয় পেয়ে থাকে; কিন্তু ছোট দলগুলো মাঝে-মধ্যে আন্ডারডগ হিসেবে আবির্ভূত হয়। যারা হারিয়ে দেয় বড় দলগুলোকে। শক্তি-সামর্থ্য এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিচারে আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশই এগিয়ে। তুলনামূলকভাবে বড় দলের তকমা বাংলাদেশের গায়েই সেঁটে আছে। আফগানিস্তান সে তুলনায় ছোট দল।

Advertisement

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কেন যেন আফগানিস্তান বাংলাদেশের সামনে ‘মস্ত বড় হাতি’ হয়ে গেছে। আফগানদের দুই স্পিনার রশিদ খান আর মুজিব-উর রহমান জুজু এমনভাবে পেয়ে বসেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের যে, সেই জুজু তাড়াতেই এখন নানা ওঝা-বদ্যির দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। নানা ঝাড়-ফুঁক দিয়েও কাজ হচ্ছে না।

ভারতের দেরাদুনে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে সেই জুজুই বাংলাদেশকে ভুগিয়েছে। একা রশিদ খানের কাছে নাকাল হয়েছে পুরো সিরিজে। মুজিব-উর রহমানও যোগ দিয়েছিলেন রশিদ খানের সঙ্গে। বাংলাদেশ সেখান থেকে ফিরেছে ধবল ধোলাই হয়ে।

এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচ। তার আগেই আফগান স্পিনের ভয়ে কাঁপাকাঁপির শুরু। তার ওপর তামিম ইকবাল নেই দলে। বাংলাদেশের ব্যাটিং শক্তির অর্ধেকই যেন নাই হয়ে গেলো। সেখানে যখন আফগান স্পিনারদের স্টাডি করে একটা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, সেখানে সেই ভয় নিয়েই খেলতে নামলো বাংলাদেশ।

Advertisement

অনুমেয়ভাবেই আফগান স্পিনারদের সামলাতে হিমশিম খেতে হলো। রশিদ খান ৯ ওভার বল করে দেন মাত্র ১৩ রান। একাই বেঁধে রাখলেন বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপকে। মুজিব-উর রহমান, মোহাম্মদ নবিরাও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই প্রভাব পড়লো ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেও।

সুপার ফোরে আবারও মুখোমুখি আফগানিস্তানের। এবার নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা চললো দলে। পরিবর্তন আনা হলো। ব্যাটিং অর্ডারেও হলো পরিবর্তন। নানা কিছিমের নানা পরীক্ষা, শুধুমাত্র আফগান স্পিনের জুজু কাটানোর জন্য। কিন্তু সেই ভয়ই কি না ধীরে ধীরে কুরেকুরে খাওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের।

দুই ওপেনার আগের দুই ম্যাচে যারপরনাই ব্যর্থ। যে কারণে দেশ থেকে উড়িয়ে নেয়া হলো সৌম্য সরকার আর ইমরুল কায়েসকে। কিন্তু আফগানদের বিপক্ষে এই ম্যাচে ওপেনিংয়ে কোনো পরিবর্তন নেই। নামিয়ে দেয়া হলো শান্ত আর লিটনকে। হয়তো বা বলে-কয়ে, নানাভাবে শিখিয়ে-পড়িয়ে তাদের নামানো হয়েছিল মাঠে।

কিন্তু ‘যাহা শুনিব, তাহা এক কান দিয়া প্রবেশ করাইয়া, অন্য কান দিয়া বাহির করিয়া দিব’-এমন পণ করেই মাঠে নেমেছিলেন শান্ত-লিটনরা। পাঁচ ওভার পর্যন্ত হয়তো বা ভুল থেকে নেয়া শিক্ষাটা মনে ছিল শান্তর। ঘরোয়া ক্রিকেটে আবাহনীর হয়ে ‘দারুণ (!)’ ব্যাটিং করা শান্ত হঠাৎই অশান্ত হয়ে উঠলেন। ইনিংসের ৬ষ্ঠ ওভারে আফতাব আলমের বলে কভারের ওপর দিয়ে উঠিয়ে মারতে চেয়েছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। বল ব্যাটের কানায় লেগে উঠে গেলো আকাশে। জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যাচটা লুফে নিলেন রহমত শাহ। রীতিমত আত্মহত্যা করে, নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে ফিরে গেলেন নাজমুল হোসেন শান্ত।

Advertisement

শান্ত ফিরতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামলেন মোহাম্মদ মিঠুন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬৩ রানের ইনিংসটা হয়তো মিঠুনকে আরও বেশ কিছুদিন দলে জায়গা নিশ্চিত করে দিলো। কিছুদিন পারফর্ম না করলেও চলবে। এ কারণে তাকে দিয়ে চলতে থাকুক পরীক্ষা-নীরিক্ষা। তিন নম্বরে নেমে নিজেকে মোটেও সেট করতে পারলেন না। মুজিব-উর রহমানের দারুণ এক ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ হয়ে গেলেন।

১৮ রানে ২ উইকেটের পতন। আবারও বাজে ব্যাটিংয়ের ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করে দিয়েছে। সময়মতো লাগাম টেনে না ধরতে পারলে কঠিন বিপদ সামনে। উইকেটে লিটন দাস আর মুশফিকুর রহীম। দু’জন মিলে ৬৩ রানের জুটি গড়ে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেনও। দারুণ ধৈর্য ধরে ব্যাটিং করে যাচ্ছেন লিটন। ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস ছিল তার ৩৬। সেটা পারও হয়ে গেছেন। হাতছানি দিচ্ছিল ক্যারিয়ারে প্রথম হাফ সেঞ্চুরির।

১৯তম ওভারে বোলিং করতে আসলেন রশিদ খান। প্রথম বলটা রান নিতে পারেননি মুশফিক। দ্বিতীয় বলে অফ সাইডে খেলে সিঙ্গেল নিলেন তিনি। স্ট্রাইকে গেলেন লিটন। তৃতীয় বলে অসাধারণ একটি শট খেললেন। অফ সাইডে থাকা বলটাকে তিনি চোখের পলকে পাঠিয়ে দিলেন এক্সট্রা কভার অঞ্চল দিয়ে। ধারাভাষ্যকাররাও মেতে উঠলেন লিটনের প্রশংসায়।

এমন এক বাউন্ডারি মারার পর আত্মবিশ্বাস বাড়ার কথা নিশ্চিত। কিন্তু সেটা যে অতিমাত্রায় বেড়ে যাবে কে জানতো? এতক্ষণ যে ধৈর্য ধরে ব্যাটিং করছিলেন, তা মুহূর্তেই ভুলে গেলেন লিটন। বোলার কে সেটাও হয়তো মাথায় ছিল না। রশিদের পরের বলের গুণাগুণ বিচার না করে আবারও মারকুটে শট খেলতে গেলেন লিটন। এবার আর ভুল করলো না রশিদের গুগলি। ব্যাটের কানায় লেগে উঠে গেলো উপরে। ইহসানুল্লাহ ক্যাচটি তালুবন্দী করে নিলেন। সমাপ্তি ঘটলো উদীয়মান একটি ইনিংসের। স্রেফ উইকেটটা বিলিয়ে দিয়েই ফিরলেন লিটন কুমার দাস।

ব্যাট করার জন্য ৫ নম্বরে মাঠে নামলেন সাকিব আল হাসান। এ সময় তার ওপর অনেক বড় দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্বের বোঝা যে এতটাই ভারী হবে কে জানতো! যে ভারী বোঝার কারণে সাকিব ভুলে গেলেন তার খেলা শটটা কোথায় গেলো। বল কি ফিল্ডারের হাতে নাকি বাইরে।

রশিদের ওই একই ওভারের শেষ বলে ফ্লিক করতে চেয়েছিলেন সাকিব। বল লেফট মিড উইকেটে সোজা ফিল্ডার সামিউল্লাহ সেনওয়ারির হাতে। তবুও সাকিব দৌড় দিলেন রানের জন্য। মাঝপথে চলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু মুশফিক তার ডাকে সাড়া না দেয়ায় ফিরতে চেষ্টা করেন সাকিব। কিন্তু সেনওয়ারির সরাসরি থ্রো ভেঙে দিলো সাকিবের স্ট্যাম্প। সাকিব স্রেফ নিজের উইকেটা ছুঁড়ে দিয়ে এলেন মাঠের মধ্যে। দলও পড়লো মহাবিপর্যয়ে।

উইকেট চলে গেলো। কিছুই তো করার নেই। ক্রিজে আছেন আশা-ভরসার প্রতীক মুশফিক। তিনি সেট হয়ে গেলে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে রান উঠবে, এটা যেন জানেন সবাই। তার সঙ্গে জুটি বাঁধলেন ইমরুল কায়েস। কিন্তু আবারও আত্মহত্যা। আবারও উইকেট। আবারও বিপর্যয়ে বাংলাদেশ। এবার আত্মহত্যার মিছিলে যোগ দিলেন মুশফিক।

রশিদ খানের পরের ওভারের (ইনিংসের ২১তম) পঞ্চম বলে ইমরুল কায়েস বলটা মোকাবেলা করলেন। ননস্ট্রাইক প্রান্তে মুশফিক। ইমরুল কল করতেই রান নেয়ার জন্য দৌড় দেন মুশফিক। কিন্তু তাকে আবার ফিরিয়ে দেন ইমরুল। ততক্ষণে স্কয়ার লেগপ্রান্ত থেকে মোহাম্মদ নবি বল কুড়িয়ে পাঠিয়ে দেন রশিদ খানের হাতে। বল ধরার আগেই অবশ্য রশিদের পায়ে লেগে একটি বেল পড়ে যায়। পরে আরেক হাত দিয়ে অন্য বেল ভাঙেন রশিদ। টিভি আম্পায়ার অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে ঘোষণা করলেন রানআউট মুশফিক।

মুড়ি-মুড়কির মতো উইকেট পড়তে পড়তে দারুণ ব্যাটিং বিপর্যয়ে বাংলাদেশ। চারটি আউটের মধ্যে তিনজনই- অর্থাৎ লিটন, সাকিব এবং মুশফিক স্রেফ নিজেদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এলেন। একের একে আত্মহত্যা করে আরও একটি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিলেন বাংলাদেশ দলকে। অথচ, সাকিব-মুশফিকের মতো খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কঠিন মুহূর্তে আরও ধৈর্যশীল আচরণই আশা করে সবাই।

আইএইচএস/আরআইপি