ভারতে দিন দিন বাড়ছে হাউজ হাজবেন্ডের সংখ্যা। এমন ১০ জন হাউজ হাজবেন্ডকে নিয়ে বিবিসির হিন্দি বিভাগ 'হিজ চয়েস' নামে ধারাবাহিক প্রতিবেদন শুরু করেছে। আধুনিক ভারতীয় পুরুষদের চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা- এসব নিয়ে তাদের নিজেদের কথাই এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
Advertisement
প্রথম প্রতিবেদন একজন পুরুষের সঙ্গে আলাপচারিতার ওপর ভিত্তি করেই লেখা। তবে তার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘একবার স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। আমার শ্যালিকার বিয়ে ছিল। আমাদের সঙ্গে ছিল আমার মেয়ে। বিয়ের নানা আচার অনুষ্ঠানে, গান-বাজনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন স্ত্রী। মেয়ে আমার কাছেই ছিল- ওর এটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে গল্প-গুজব করছিলাম, এমন সময় মেয়ে পটি করে ফেলে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে পরিষ্কার করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার শাশুড়ি আমাকে আটকালেন।
কানে কানে বললেন, "তুমি এ বাড়ির জামাই। কী করছ তুমি বুঝতে পারছ? আত্মীয়-স্বজন দেখে কী বলবে কোনো ধারণা আছে? সোনালীকে ডাক। বাচ্চার পটি সে পরিষ্কার করে নতুন ডায়াপার পরিয়ে দেবে।"
Advertisement
সোনালী আমার স্ত্রীর নাম। আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে মেয়ের পটি পরিষ্কার করার অভ্যাস আছে আমার। কিন্তু তার আগেই শাশুড়ি আমার স্ত্রীকে ডাক দিলেন। বললেন, "যাও, মেয়ের পটি পরিষ্কার করে নতুন ডায়াপার পরিয়ে দাও।"
আমি আর আমার স্ত্রী দু'জনেই দু'জনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তবে কিছু বলার আগেই শাশুড়ি বেশ চাপা গলায় ধমকের সুরে স্ত্রীর নামটা শুধু বললেন, "সোনালী....!"
আমার স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। ঘটনাটা খুব অদ্ভুত লেগেছিল আমার। আমি যে ‘হাউজ-হাজব্যান্ড' সেটা তো শ্বশুর-শাশুড়ি জানেন। মেয়ের পটি পরিষ্কার করাটা আমার কাছে নতুন কোনো কাজ তো নয়! সম্ভবত আমার শাশুড়ির কাছে ব্যাপারটা লজ্জার ছিল। কয়েকজনকে দেখছিলাম মিটি মিটি হাসছেন। তারপর থেকে ওই বিয়েবাড়ির হই-হট্টগোলের মধ্যেও কয়েকবার আমার কানে একটা কথা এসেছে - আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, "এই ভদ্রলোক তো হাউস হাজব্যান্ড"।
আমার শ্বশুর-শাশুড়ি চাইতেন না বিষয়টা পাঁচকান হোক। তবে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম যে আমার লজ্জা পাওয়ার যেমন কোনো কারণ নেই, তেমনই আমাদের চিন্তাভাবনাও পাল্টাব না।
Advertisement
আমরা ভিন্ন জাতে বিয়ে করেছি। প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আমি বা আমার স্ত্রী - যে কেরিয়ার গড়ার ভাল সুযোগ পাবে, সেই কেরিয়ার গড়বে, অন্যজন ঘর-সংসার সামলাবে।
শুরু থেকেই আমার নিজের কেরিয়ারটা খুব একটা ভাল চলছিল না। অন্যদিকে আমার স্ত্রী বেশ উন্নতি করছিল তার কেরিয়ারে। তখনই ঠিক করি, আমি ঘর সামলাব আর সোনালী চাকরি করে আরও উন্নতি করবে।
‘বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মশকরা করতে লাগলো’
আমাদের বাড়িতে কাজ করার জন্য কোনো গৃহকর্মী নেই। আমিই ঘর পরিষ্কার করি, বাসন মাজি, বাজার করি আবার রান্নাও করি। অন্যদের হয়তো আমার এ বাড়ির কাজকর্ম করা অদ্ভুত লাগত, কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা খুব সাধারণ ছিল।
তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি ছোট। ছোট থেকেই বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করতাম। তখনও দেখতাম বন্ধুরা আমাকে 'গৃহিণী' নামে ডেকে চটাতো। তবে দিল্লিতে পড়াশোনা জানা বন্ধুবান্ধবরা আমার এ বাড়ির কাজ করার ইচ্ছাটাকে বুঝতে শুরু করেছে। কিন্তু যখন নিজের শহর ভোপালে যাই, সেখানকার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মশকরা করতে লাগল।
রাজনীতি বা অন্য কোনো গম্ভীর বিষয় নিয়ে যখন আলোচনা হয় আর সেখানে যদি আমি কিছু বলতে যাই, তাহলে মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বন্ধুরা বলে "তুমি এসব বুঝবে না, এটা গুরুতর বিষয়।"
বোধহয় আমাকে নিজের জায়গাটা, অর্থাৎ বাড়ির চৌহদ্দিটা চিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ওই বন্ধুরা। একবার এমনও হয়েছে, কী একটা বিষয়ে যেন বন্ধুরা কথা বলছিল, আর যেই আমি কিছু বলতে গেলাম, তখন ওরা বলল, "আরে তুই এসব বুঝবি না, একটু চা বানিয়ে আন বরং।" আমি হেসে বলেছিলাম, ‘শুধু চা কেন, পাকোড়াও ভেজে আনছি।’
আমি এই সব ঠাট্টা, মশকরা সিরিয়াসলি নিই না। মানুষ আসলে বাড়ির কাজটাকে কাজ বলে গণ্যই করে না। অনেকেই বলে আমি নাকি ঘরে বসে আয়েশ করি। কিন্তু ওরা এটা জানে না, যেসব পুরুষ অফিস বা কাজে যাওয়ার জন্য যেমন ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে, আমিও তেমনই খুব সকালে উঠি। তারপরে ঘর আর বাইরের সংসারের সব কাজ করি।
আমাদের বিয়ের চার বছর পরে মেয়ে হয়েছে। তাই এখন আমার দায়িত্বও বেড়ে গেছে। মা হওয়া তো একটা পুরো সময়ের কাজ! সংসারের কাজের সঙ্গেই এখন মেয়ের দেখাশোনার দায়িত্বও আমার। তাকে গোসল করাতে, খাওয়াতে হয়, ঘুম পাড়াতে হয়, ঘুরতে নিয়ে যেতে হয়।
যখন মেয়েকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যেতে শুরু করলাম, প্রথম প্রথম সেখানে নারীরা আমার মেয়েকে আদর করতেন বেশ। চার-পাঁচদিন পরে কয়েকজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আজকেও আপনিই এসেছেন মেয়েকে নিয়ে? ওর মা কোথায়? তার কী শরীর ভাল নেই?"
এরকম নানা প্রশ্ন করা শুরু হল। আমি জবাব দিয়েছিলাম, ‘স্ত্রী চাকরি করেন। আমিই মেয়ের দেখাশোনা করি।’ তারপরে একের পর এক প্রশ্ন শুরু হল, ‘এত ছোট বাচ্চাকে আপনি কী করে সামলান? ও আপনার কাছে থাকে? গোসল করায় কে? খাইয়ে দেয় কে?" ইত্যাদি ইত্যাদি।বুঝতে পারতাম পার্কে বেড়াতে আসা ওই নারীরা আমার পেছনে মজা করেন আমাকে নিয়ে।
বিয়ের পরে যখন প্রথমবার আমার বাবা-মা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তখন সংসারের কাজকর্ম আমাকে করতে দেখে সেটা বেশ অপছন্দ হয়েছিল মায়ের। মা যদিও কিছু বলেননি, তবে হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তার পছন্দ হচ্ছে না।
সোনালীও বুঝেছিল যে আমার মা পছন্দ করছে না ব্যাপারটা। তাই নিজ থেকেই সংসারের টুকটাক কাজ করতে শুরু করেছিল বাবা-মায়ের সামনে। কিন্তু অভ্যাস না থাকলে যা হয়, কোনোটাই ঠিকমতো করে উঠতে পারছিল না। আমিই তখন ওকে নিষেধ করলাম যে লোক দেখানোর জন্য কাজ করতে হবে না। মা-ও ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলেন। কিন্তু কিছু বলেননি। তারপর থেকে এই ব্যাপারে আর কোনো কথাই বলেননি মা।
এখন আমার মেয়ে স্কুলে যায়। ওকে বংশ-লতিকা বানাতে দিয়েছিল একবার স্কুল থেকে। আমি কোনো কাজে বোধহয় বাইরে গিয়েছিলাম, আমার স্ত্রী ওকে বংশ-লতিকা বানাতে সাহায্য করেছিল। সেখানে আমাকে 'হেড অফ দা ফ্যামিলি' বলে লিখেছিল। ফিরে এসে আমি ওটা দেখে বলেছিলাম, চাকরি করে রোজগার করে সোনালী, সংসারে অর্থ সেই যোগায়। তাই 'হেড অফ দা ফ্যামিলি' তো তার হওয়ার কথা।
কিন্তু সোনালীর বক্তব্য ছিল অন্য। ও বলেছিল, 'যে সংসার চালাবে, সেই হেড অফ দা ফ্যামিলি হবে - তা সে পুরুষ হোক বা নারী।’ বংশ-লতিকায় ‘হেড অফ দা ফ্যামিলি'র জায়গা থেকে আমার নামটা সরাতে দেয়নি সোনালী। আমি অবশ্য একেবারেই যে অন্য কিছু করি না, তা নয়।
লেখালেখি করি ফ্রিল্যান্সার হিসাবে। সংসারের কাজকর্মের মধ্যেই বাড়িতে বসে লেখালেখি করি। দুটো বই ইতোমধ্যেই ছাপা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তিন নম্বর বইটা বের হবে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই আমাদের সংসারের ধরনটা বুঝে উঠতে পারে না। আমার স্ত্রীকেও ওর অফিসে নানা কথা শুনতে হয়। তবে আমাদের দু'জনের মধ্যে এতটাই ভালবাসা রয়েছে, যে আমরা এগুলোকে পাত্তাই দিই না।
আমার বড় দুই ভাই অবশ্য আমার এ ঘর-সংসার সামলানো নিয়ে কিছু বলেন না, তবে কখনও প্রশংসাও করেন না। কিন্তু পরিবারের অন্য নারীরা দেখেছি আমাকে বেশ সম্মান করেন। যখন এমন কিছু করবেন, যেটা অন্যদের থেকে আলাদা, তখন প্রথমে মানুষ মজা করবে, তারপরে সমালোচনা করবে, অবশেষে মেনে নিতে শুরু করবে। আমি এখন সেই প্রথম ধাপটায় রয়েছি।
এনডিএস/এমএস