শনিকেতের বয়স তখন আড়াই বছর। একদিন বিকেলে বাবা-মা লক্ষ্য করলো একমাত্র ছেলে শনিকেতের বাম চোখটি লাল হয়ে গেছে। পরদিনই বাবা সঞ্চয় কর্মকার ছেলেকে নিয়ে হাজির হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের ডাক্তার রবিউল আলমের কাছে। ডাক্তার চোখ দেখেই ধারণা করলেন, ভাইরাসের কারণে লাল হয়ে গেছে। তিনি ওষুধ দিলেন। দুই-তিন দিন ওষুধ খেয়ে কিছুতেই চোখের সমস্যা কমছিল না। বরং দিন দিন চোখটা ফুলে ভেতর থেকে বের হয়ে আসছিল।
Advertisement
ফুটফুটে সন্তানের চোখের এমন অবস্থা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না বাবা-মা। এজন্য আর সময় ক্ষেপণ না করে ছেলেকে নিয়ে হাজির হলেন সিরাজগঞ্জের আরেক ডাক্তারের কাছে (নাম মনে নেই)। সেই ডাক্তার শনিকেতের চোখ দেখেই কোনো চিকিৎসা না দিয়ে পরামর্শ দিলেন দ্রুত ঢাকার খামারবাড়িতে অবস্থিত ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। সেখানে এক নারী ডাক্তারের নামও বলে দিয়েছিলেন তিনি (নাম মনে নেই)।
সামান্য জুয়েলার্সের কর্মচারী সঞ্চয় কর্মকার ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে আসার পরামর্শে বেশ চিন্তায় পড়ে যান। কারণ ঢাকা নিয়ে আসার মতো অর্থ ছিল না তার কাছে। এলাকাবাসীর কাছে সাহায্য তুলে এক সপ্তাহ পর ছেলেকে নিয়ে রওয়ানা হলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।
ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেই ডাক্তারকে দেখানোর পর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে টিউমারের কথা জানিয়ে অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে বলেন সঞ্চয় কর্মকারকে। তিন দিন ভর্তি থাকার পর চোখের অপারেশন হয় শনিকেতের। ৭ দিন পর তাদের রিলিজ দিয়ে এক মাস পর আবার আসতে বলা হয় তাদের।
Advertisement
বাড়ি যাওয়ার পর আবারও ফুলতে থাকে শনিকেতের চোখ। এবার ঢাকায় না এসে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সঞ্চয় কর্মকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাড়ির ভিটেমাটি বিক্রি করে ছেলেকে নিয়ে যায় ভারতের চেন্নাইয়ে শঙ্কর নেত্রালয় হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন শনিকেতের টিউমার থেকে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতাল থেকে জানানো হয় ক্যান্সারের জন্য ১০টির মতো কেমোথেরাপি দিতে হবে। তিনটি কেমো দেয়ার পর টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন সঞ্চয় কর্মকার।
দেশে ফিরে শনিকেতের অবস্থা সেই আগে মতোই হয়ে যায়। চোখের বাইরে বেরিয়ে আসে বিশাল এক মাংসপিণ্ড। কিছুদিন পর ছেলেকে নিয়ে পুনরায় ভারতে গেলেও কোনো চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত দেয় তারা।
দেশে এসেই ছেলেকে নিয়ে হাজির হন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু শনিকেতের চোখের অবস্থা এতটাই ভয়ানক আকার ধারণ করেছিল যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর তাকে ভর্তি করা হয় সিরাজগঞ্জ শহরের একটি ক্লিনিকে। তিন দিন ভর্তি রেখে তারা ছেড়ে দেয়।
ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধীরে ধীরে নিঃস্ব হতে থাকে শনিকেতের বাবা। বাড়িতে যা কিছু বিক্রি করার ছিল সব বিক্রি করে দুই বছর ধরে ছেলেকে সুস্থ করতে লড়ছেন তিনি।
Advertisement
এরপর অভাবের কারণে ছেলেকে নিয়ে হাজির হন এলাকার এক হোমিও চিকিৎসকের কাছে। দুই মাস হোমিও খাওয়ানোর পর ডাক্তার জানিয়ে দেন ক্যান্সার রোগীরা হোমিও চিকিৎসায় সুস্থ হয় না।sssছেলেকে নিয়ে ঢাকা, ভারতের চেন্নাই, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী ছুটোছুটি করতে কেটে যায় দুই বছর। এরপর এলাকাবাসীর পরামর্শে ৬ মাস আগে ছেলেকে নিয়ে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল হাসপাতালে আসার প্রস্তুতি নেন। পথে রাজশাহীতে বাসের সিটের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শনিকেতের টিউমারটি ফেটে যায়। সেখান থেকে দ্রুত তাকে খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল হাসপাতালে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পুনরায় তার চোখের অপারেশন করা হয়।
বর্তমানে এ হাসপাতালেই চিকিৎসা চলছে শনিকেতের। গত ৬ মাসে একাধিকবার খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে শনিকেত।
সর্বশেষ চলতি মাসের ১৫ সেপ্টেম্বর তাকে হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. দীপক শংকর রায়ের পর্যবেক্ষণে রয়েছে সে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ১৩নং ওয়ার্ডের শিবতলা চাইপাড়া গ্রামের সঞ্চয় কর্মকারের ছেলে শনিকেত। দীর্ঘ আড়াই বছর থেকে চোখের যন্ত্রণায় কাতর শনিকেতের বয়স আগামী বছরের ১৯ জানুয়ারি তার বয়স ৫ বছর পূর্ণ হবে। বড় বোন এলাকার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়লেও তাকে ছুটতে হচ্ছে এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল। পৌর এলাকার সৃষ্টি জুয়েলার্সের কর্মচারী সঞ্চয় কর্মকার জানান, অভাবের সংসারে ছেলের চিকিৎসা করাতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন বাড়ি ভিটে, চাকরি কিছুই নেই। এখন আমি ভিক্ষুক। এলাকার এমন কেউ বাদ নেই যার কাছে সহযোগিতা চাইনি। অনেকেই সহযোগিতা করেছে। তাদের সহযোগিতা নিয়েই ছেলেকে ভর্তি করেছি খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল হাসপাতালে। জানি না কতদিন এখানে চিকিৎসা চালাতে পারবো?
তিনি বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার শনিকেতের বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে বোনমেরুও পরীক্ষা করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে রিপোর্ট দেবে। জানি না রিপোর্টে কি আসবে? রিপোর্টে ভালো খারাপ আসলেও আমার করার আর কিছুই নেই্। সব শেষ করে ফেলেছি। কতবার মানুষের কাছে আর হাত পাতবো। এলাকার মানুষ বিরক্ত আমার উপর।
সঞ্চয় বলেন, ছেলেকে বাঁচাতে পারবো যদি কোনো হৃদয়বান সুদৃষ্টি দেন তাহলে। তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের হৃদয়বান মানুষগুলোর সহযোগিতা চেয়েছেন। শনিকেতকে কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন তার বাবা সঞ্চয় কর্মকারের নম্বরে ০১৭২২-৫০৩৯৫৬।
শনিকেতের বিষয়ে কথা হয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. দীপক শংকর রায়ের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, বোনমেরুর রিপোর্ট হাতে পাবার পর বুঝতে পারবো তার চিকিৎসা সম্ভব কীনা? সেই রিপোর্টেই বুঝতে পারবো তার চিকিৎসা দেশে সম্ভব নাকি বিদেশে? রিপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত অনুমান করে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে তিনি এটাও বলেন, রিপোর্টে ভালো কিছু পাওয়া গেলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে তার চিকিৎসা সম্ভব।
এমএএস/পিআর