বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ পাস করেছে জাতীয় সংসদ। আইনের আটটি ধারার বিষয়ে সম্পাদক পরিষদের আপত্তি আমলে না নিয়েই এটি পাস হলো। আইনের ৩২ ধারায় অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট প্রয়োগ করে সরকারি কোনো কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যকে (‘তথ্য পাচারের’) অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অপরাধ সংঘটন ও সংঘটনে সহায়তার দায়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যদি কেউ একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
Advertisement
বুধবার জাতীয় সংসদে বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এর আগে বিলের ওপর আনীত সংশোধনী, জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
বিলটি সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় সম্পাদক পরিষদ ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক এবঙ তাদের সুপারিশ বিলটিতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে উল্লেখ করা হলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করে তা প্রত্যাখ্যান করে সম্পাদক পরিষদ।
সংগঠনটি রোববার এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বেগ এই প্রতিবেদনে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। বিলটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর হুমকি।
Advertisement
আইন প্রয়োগে কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেয়ার বিধান বাতিলের জন্য আনা বিরোধী দলের সংশোধনী প্রস্তাব উপেক্ষা করেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়েছে। আইনে বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি ও গ্রেফতারের পাশাপাশি ক্ষতিকর তথ্য-উপাত্ত ব্লক বা অপসারণের বিধানও রাখা হয়েছে।
বিলের ৮ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ, ক্ষেত্রমত ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবেন।’
একই ধারায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় মহাপরিচালকের মাধ্যমে একইভাবে তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইনের এ ধারায় সরকারকে অবহিত করে বিটিআরসিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্ত অনুরোধ কার্যকর করার সক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকার অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকার অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
২৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতিপ্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয়প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন বা (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
Advertisement
২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করে, তাহলে তিনি ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২৯ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে প্যানাল কোডের ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর কোনো তথ্য প্রচার বা প্রকাশ করেন, তাহলে তিনি ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩১ নং ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শক্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তিনি ৭ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি (অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট ১৯২৩-এর আওতাভুক্ত) কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যদি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৪৩ নং ধারায় পুলিশকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, মালামাল জব্দ ও গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে পুলিশ যে কোনো স্থানে প্রবেশ, তল্লাশি করতে পারবে এবং বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ও দলিলাদি জব্দ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। তবে তল্লাশি সম্পন্ন করার পর এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালকে প্রতিবেদন দিতে হবে।
বিলের ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুসারে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটনে জড়িত কম্পিটার, কম্পিউটার সিস্টেম, ফল্পি ডিস্ক, কম্প্যাক্ট ডিস্ক, টেপ-ড্রাইভ বা অন্য আনুষঙ্গিক উপকরণ বাজেয়াপ্ত হবে।
বিলের ৫৫ ধারায় এই আইনের অধীনে সংঘটিত কোনো অপরাধের তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিধান রাখা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, ‘প্রয়োজন হলে ‘অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইন ২০১২-এর বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে।’
আইনের ৫৬ ধারা অনুযায়ী, জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালক প্রয়োজনবোধে এই আইনের বলে তার ওপর অর্পিত যে কোনো ক্ষমতা বা দায়িত্ব লিখিতভাবে এজেন্সির কোনো কর্মচারী এবং অন্যকোনো ব্যক্তি বা পুলিশ অফিসারকে অর্পণ করতে পারবেন। এই আইনের অধীনে কৃত সব কাজকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
‘সরল বিশ্বাসকৃত কাজকর্ম’ শিরোনামে বিলের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীনে দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসেকৃত কোনো কাজের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, তজ্জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।’
তবে সম্পাদক পরিষদ তাদের বিবৃতিতে বলেছিল, এই প্রতিবেদন আমরা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা, খসড়া আইনটির ৮,২১, ২৫,২৮, ২৯,৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারায় মৌলিক কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। এই ধারাগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর হুমকি।
এইচএস/জেডএ/এমএস