আগস্ট মাস এলেই আওয়ামী লীগের নেতাদের নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বলতে শুনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদেরও বিচার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাও প্রায় সময় এধরনের কথা বলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ষড়যন্ত্রকারী কয়েকজনের নামও বলে দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ওই ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা হয়নি। আজ থেকে ৪০ বছর আগের সেই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী কারা ছিল সেটা অজানা নয়। আবার আনুষ্ঠানিকও নয়। বক্তৃতা বিবৃতি সাক্ষাৎকারসহ নানাজনের গবেষণায় বিষয়টি বিক্ষিপ্তভাবে ওঠে এসেছে। হত্যাকাণ্ডের পর ২১ বছর সামরিক ও রাজনৈতিক, স্বৈরাচার ও কথিত গণতান্ত্রিক সব ধরনের সরকারই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছিল। শুধু তাই নয়, বিচার যেন করা না যায় সেজন্য আইনও করে রেখেছিল। তাই রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনার কোনো তদন্তই হয়নি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই বছর ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারিক আদালত রায় দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা তদন্তের সময় শুধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা হয়েছে। এ হত্যার পেছনে কারা মদত দিয়েছে, নেপথ্যে কলকাঠি কারা নেড়েছে, আন্তর্জাতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না-এই বিষয়ে তদন্তই করা হয়নি। রাষ্ট্রও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হলেও এর অনেক আগে থেকেই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আর এ খবর দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জানতে পারে। এখন এ বিষয়টি অনেকটাই খোলা বইয়ের মতো- যে কেউই পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ৩০ বছর পর তাদের গোপন নথিপত্র জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ায় এখন অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাস্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত একটি নথিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার কথা উল্লেখ রয়েছে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে এসব তথ্য সেসময় প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জড়িত থাকার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ি হওয়াটা যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পরাজয়ই মনে করেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তখন সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে আন্তর্জাতিক মহলের ইন্ধনে সায় দিয়েছিল আওয়ামী লীগেরই নেতা খন্দকার মোশতাক ও তখনকার উপসেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া, কর্নেল তাহেরের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক রহমান ঘটনার পরপর বিদেশী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, হত্যার পরিকল্পনা তিনি করেছেন আর খন্দকার মোশতাক আহমেদ সব জানতেন। তাদেরকে ব্যাংককে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানকে জানানো হয়েছিল। ফারুক ও রশিদের যে সাক্ষাৎকারটি ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন সহজলভ্য সেখানে দেখা যায় তারা ১৫ আগস্টের ৬ মাস আগেই খন্দকার মুশতাক ও জেনারেল জিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জিয়া তাদের বলেছিলেন- একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে হত্যাকাণ্ডে তার পক্ষে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়, তবে জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু করতে চায় তাতে তিনি বাধা দেবেন না। কর্নেল রশিদ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে কর্নেল তাহেরের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়। এটা স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল একটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র । এর পক্ষে অনেক তথ্য প্রমাণ হাজিরও করা যাবে। প্রশ্ন হলো এত তথ্য প্রমাণ থাকার পরেও রাষ্ট্র কেন সেটি প্রমাণিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে না। আর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এবং বঙ্গবন্ধুরই কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তখন এই কাজটি কেন করা হচ্ছে না? শুধু বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা না নিয়ে কার্যকর একটা উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। এটাতো ঠিক শুধু খুনিরাই নয় খুনিদের নেপথ্যকারিরাও সমান অপরাধী। তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে না পারলেও তাদের চিহ্নিত করা রাষ্ট্রেরই দায়। ইতিহাসের এই সত্য উদঘাটনের জন্য সরকারের উচিত একটি কমিশন গঠন করা, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সাহায্যও সরকার আহ্বান করতে পারে। রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যার পেছনে কারা কলকাঠি নেড়েছে এটা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। ইতোমধ্যে ৪০ বছর পার হয়ে গেলেও সত্য উদঘাটনে সময়ের ব্যবধান কোনো বাধা হতে পারে না।এইচআর/এমএস
Advertisement