মতামত

বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও কিছু প্রশ্ন

কালের নিয়মে আমরা সবাই একদিন বৃদ্ধ হব, যৌবনের সোনালি দিন পেরিয়ে বার্ধক্যের শীতল রাত সবার জীবনেই কম বেশি আসবে, এই সত্যটা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারি না। যৌবনের আনন্দ, ব্যস্ততা আমাদেরকে এতোই মাতিয়ে রাখে যে বার্ধক্যকে এক অসম্ভব পরিণতি মনে হয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, যৌবনে বা পরিণত বয়সে মানুষের দায়িত্ব থাকে অনেক বেশি। নিজের কাজ, রুটি রুজি, সংসার, স্বামী বা স্ত্রীকে সময় দেওয়া, এবং সবার উপরে সন্তান মানুষ করতে যেয়ে আমারা সবাই কম বেশি হাবুডুবু খাই।

Advertisement

সময়, শক্তির সবটুকুই এর পেছনেই খরচ করে ফেলি। অনেক সময় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, বা অপরাধবোধ থাকা সত্ত্বেও জীবনের অন্যান্য প্রয়োজন মিটিয়ে বৃদ্ধ বাবা, মায়ের সেবা যত্ন করার সৌভাগ্য সবার হয় না বা আমরা সেটা করি না। প্রকৃতির আরেক নিয়মে প্রকৃতিই মানুষকে শিখিয়েছে সন্তান জন্ম দাও, তাকে লালন পালন কর, প্রকৃতিই সন্তানের জন্য অপার স্নেহ তৈরি করে দেয় মানুষের মনে।

এসব করতে গিয়ে বৃদ্ধ মা, বাবার প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য বোধ ঢাকা পড়ে যায়। তাই বুঝি, বিভিন্ন ধর্মে মানুষকে বার বার করে মনে করিয়ে দিয়েছে বৃদ্ধ মা- বাবার দেখা শোনা করতে। মানবতার ধর্ম মনে করিয়ে দিয়েছে তাদের জন্যই আমরা জীবন পেয়েছি আর আজ আমরা আমাদের অবস্থানে আছি।

এই দায়িত্বের টানাপোড়েনে প্রায়ই সমালোচনা শুনি বৃদ্ধাশ্রমগুলো কত খারাপ এবং একমাত্র নিষ্ঠুর সন্তানরাই পারে বাবা, মাকে সেখানে রেখে আসতে। আজ আমি সেই আলোচনায় যাব না। তবে, বাবা, মায়ের দায়িত্ব নিয়ে যে সন্তানরা অনেক সময় বুঝে বা না বুঝে, তাদের অনেক মানসিক এবং শারীরিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেগুলো নিয়ে কিছু কথা বলব। এই আলোচনার মূল প্রেক্ষাপট শহর ভিত্তিক আধুনিক পরিবারগুলো। কয়েক জন বৃদ্ধ বৃদ্ধার গল্প শুনি-

Advertisement

এক.

কুদ্দুস সাহেব একজন রিটায়ার্ড বিপত্নীক মানুষ। স্ত্রী ছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সে চলে যাওয়ার পর থেকে কুদ্দুস সাহেবের খুব একলা লাগে। অনেক কষ্টে সে সেটা মানিয়ে নিয়েছেন। তবে বড় নিঃসঙ্গ লাগে সব সময়, হাঁপিয়ে উঠেন তিনি। ছেলের সাথেই থাকেন। একটি ফুটফুটে নাতি আছে। ছেলে ছেলের বউ তাদের জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তার সাথে বসে কথা বলার কোন সময় তাদের নেই। তিনি কষ্ট পেলেও অভিযোগ করেন না। ওদের ব্যস্ততাটা উনি বোঝেন।

নাতি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ওনার উপরে দায়িত্ব পড়েছে ওকে স্কুল থেকে আনা, নেওয়া করা। জামে বসে থাকতে কষ্ট হলেও উনি এই কাজটা উপভোগ করেন, অন্তত কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। নিজেকে সংসারে একজন দরকারি মানুষ মনে হয়। সেদিন তার পুরনো অফিসের কলিগ রহমান সাহেব ফোন করেছিলেন। কথা বলে খুব ভাল লাগলো। কথায় কথায় রহমান সাহেব তাকে দাওয়াত দিতে চাইলেন। তাদের সাথে একদিন দুপুরে খেতে যেতে।

কুদ্দুস সাহেবের এতো আনন্দ হল, ভাবতেই ভাল লাগছে যে পুরনো বন্ধুর সাথে একটি পারিবারিক পরিবেশে খাবে, গল্প করবে। সে তো দুপুরে রোজ একাই খায়। রাতেও মাঝে মাঝে। কিন্তু তিনি বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলেন। রহমান সাহেব তাকে যেতে বলেছেন অফিসের দিনে, তার ছেলে তখন বাসায় থাকে না। কিন্তু, তিনি বেড়াতে গেলে নাতিকে কে আনা নেওয়া করবে? ছেলে বা ছেলের বউকে এ কথা জিজ্ঞাসা করার তার সাহস নেই। নিজেকে কেন যেন একজন বন্দি মানুষ মনে হয়।

Advertisement

দুই.সেতারা বেগমের এক ছেলে, এক মেয়ে। দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত। ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেছে, কারণ তার শাশুড়ি বৃদ্ধা। শ্বশুর বেঁচে নেই। তাকে দেখা শোনা করার জন্য। সেতারার মেয়ে মুনিয়া একটা বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করে, তার স্বামী কিছুদিন আগে বিদেশে গেছে পড়তে। মুনিয়ার বাচ্চার বয়স এক বছর । সে এখন মায়ের বাসাতেই থাকে। এক বছরের বাচ্চা দেখা শোনা করার জন্য মায়ের চেয়ে উত্তম কোন মানুষ নেই। সেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আগের মত ধৈর্য নেই।

দুপুরে খাওয়ার পরে একটু শোয়ার অভ্যাস। এখন আর সুযোগ হয় না। বিকেল হতে হতে কেমন যেন এলোমেলো লাগে। দিনের পর দিন ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেছাতে থাকেন।মেয়ের ছুটি নেই। সব কিছু তিনি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু খুব খারাপ লাগে, যখন রাতে বাসায় এসে মেয়ে বাচ্চাটাকে গাল টিপে আদর করে নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে ঘুম দেয়।

সে নাকি খুব ক্লান্ত সারাদিনের খাটুনিতে, তার বিশ্রাম প্রয়োজন। বাচ্চা মাকে চেনে। সে তখন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদতেই থাকে, তিনি থামাতে পারেন না। এদিকে স্বামী ডায়াবেটিসের রুগী, তাকেও সময় মত খাওয়া দিতে হয়। তিনি কিছুতেই আর পেরে উঠেন না।

এই ঘটনাগুলো কিন্তু আমার আপনার জীবনেরই ঘটনা। বৃদ্ধ বাবা, মায়ের দায়িত্ব নেওয়া সহজ কাজ নয়। তবে সব সময় মাথায় রাখতে হবে, তারাও মানুষ, তাদের মন আছে। আর মনে রাখতে হবে, একসময় যে দুরন্ত যুবক বাবা আর মা দুর্গা রূপী মাকে দেখেছি, তারা আর সেই মানুষ নেই। তারা কিছুটা শিশুর মত, আবার কখন বড়দের মত। তাদের জীবনে সামাজিকতার প্রয়োজন আছে। তাদেরকে তাদের কর্ম ক্ষমতা অনুযায়ী ব্যস্ত রাখুন, তবে দায়িত্বের স্ট্রেস যেন না পড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখুন।

এইচআর/জেআইএম