খালি চোখে দেখা যাচ্ছে এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। যা কিনা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়। টাইগারদের করা ২৬১ রানের জবাবে লঙ্কানরা অলআউট হয় মাত্র ১২৪ রানে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় মাশরাফি-মিরাজদের বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা।
Advertisement
বল হাতে মাশরাফি বিন মর্তুজা কিংবা মেহেদি হাসান মিরাজদের দাপটের আগে ব্যাট হাতে লঙ্কান বোলারদের শায়েস্তা করেছেন মুশফিকুর রহিম ও মোহাম্মদ মিঠুন। আর শেষদিকে তামিম ইকবালের সাহসিকতা ও দলের প্রতি নিবেদনের কথা এখনো সবার মুখে মুখে। এতসব কিছুর মাঝে আড়াল হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার দিকটা।
বাংলাদেশের করা ২৬১ রানের জবাবে লঙ্কানরা ব্যাট করতে নামলে শুরুতে খানিক এলোমেলো বোলিং করেছিলেন মাশরাফি ও মোস্তাফিজ। রান তুলে ফেলছিলেন ওপেনার উপুল থারাঙ্গা। দ্বিতীয় ওভার থেকেই শুরু পাল্টা আঘাতের। যা চলতে থাকে ৩৬তম ওভারে লংকানরা অলআউট হওয়া পর্যন্ত। বল হাতে নেয়া ছয়জনের সবাই নেন অন্তত একটি করে উইকেট। মাশরাফি, মিরাজ ও মোস্তাফিক নেন ২টি করে উইকেট। সাকিব, মোসাদ্দেক ও রুবেল নেন ১টি করে উইকেট।
সে তুলনায় একদম নিষ্প্রভ ছিলেন ব্যাটসম্যানরা। দলের ২৬১ রানের মধ্যে পঞ্চান্ন শতাংশ তথা ১৪৪ রান একাই করেন মুশফিক। ৬৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস আসে মোহাম্মদ মিঠুনের ব্যাট থেকে। এ দুইজনের করা ২০৭ রান বাদ দিলে দলের বাকি পাঁচ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান মিলে করেন মাত্র ৪ রান। ইনজুরিগ্রস্ত তামিম ইকবালের অপরাজিত ২ রান বাদ দিলে বাকি চারজনের নামের পাশে সবমিলিয়ে বাকি থাকে মাত্র ২ রান।
Advertisement
ইনিংসের প্রথম বলেই সিঙ্গেল নিয়ে লিটন দাশকে স্ট্রাইক দেন তামিম। সে ওভারের পঞ্চম বলে অযথাই অফস্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়ে স্লিপে ক্যাচ তুলে দেন ১৩ ম্যাচের ক্যারিয়ারে তৃতীয়বারের মতো ফেরেন শূন্য রানে। পরের বলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মালিঙ্গার 'আনপ্লেয়েবল' ডেলিভারিতে সরাসরি বোল্ড বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এ আউটে সাকিবের দায় খুব অল্পই। তবু টপঅর্ডারের দুই ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে প্রাপ্তি তখন শূন্য।
দ্বিতীয় ওভারে কব্জির ইনজুরিতে মাঠ ছাড়েন তামিম। তখন তার নামের পাশে রান ২। অর্থ্যাৎ টপঅর্ডারের তিনজন মিলে দলের সংগ্রহে যোগ করেন মাত্র ২ রান। সেখান থেকে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেন মুশফিকুর রহিম ও মোহাম্মদ মিঠুন। মুশফিক সামলে রেখেছেন এক প্রান্ত, অন্য প্রান্তে রানরেটের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাট করে গেছেন মিঠুন। করেন ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশত, খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ৬৩ রানের ইনিংস।
বাংলাদেশ দলের মোট সংগ্রহ থেকে মিঠুনের এই রান বাদ দিলে বাকি থাকে মাত্র ১৯৮ রান। লক্ষ্য হিসেবে দুইশ'র কম রান পেলে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ বা রান তাড়া করার পরিকল্পনা যে হতো পুরোপুরি ভিন্ন, তারা খেলতো আরও দেখেশুনে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মিঠুনের ইনিংসের মাহাত্ম্যটাও ঠিক এখানে।
১৩১ রানের জুটি গড়ে দলীয় ১৩৪ রানের মাথায় সাজঘরে ফেরেন মিঠুন। ইনিংসের তখনো বাকি প্রায় ২৫ ওভার। বাকি পথটুকু সামাল দেয়ার দায়িত্ব ছিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের কাঁধে। কিন্তু নিজের খেলা চতুর্থ বলেই ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা করেন মাহমুদউল্লাহ, ১ রান নিয়ে ফিরে যান সাজঘরে। তার দেখাদেখি মাত্র ৫ বল খেলেই মালিঙ্গার স্লোয়ার ডেলিভারিতে ১ রান করেই কাঁটা পড়েন শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক।
Advertisement
উইকেটে তখনো নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী হয়ে টিকে ছিলেন মুশফিকুর। কিন্তু মিঠুন ব্যতীত স্বীকৃত ৫ ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে মাত্র ৪ রান আসাটা চাপে ফেলে দেয় বাংলাদেশকে। বোলারদের নিয়েই লড়াই শুরু করেন মুশফিক। মেহেদি মিরাজের সাথে গড়েন ৩৩ রানের জুটি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিরাজ আউট হন ব্যক্তিগত ১৫ রানের মাথায়।
এরপর অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ১০, রুবেল হোসেন ২ ও মোস্তাফিজুর রহমান ১০ রানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলে ২০০ ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। আর শেষ উইকেটে ভাঙা হাত নিয়ে তামিম নেমে বাড়তি সাহস যোগান মুশফিককে। সেই সাহসেই ক্যারিয়ার সেরা ১৪৪ রানের ইনিংস খেলেন মুশফিক, বাংলাদেশ পৌঁছে যায় ২৬১ রানের লড়াকু সংগ্রহে।
অথচ ২৬তম ওভারে তৃতীয় উইকেট হিসেবে যখন মিঠুন আউট হন তখন বাংলাদেশের সম্ভাব্য দলীয় সংগ্রহ দেখাচ্ছিলো ২৯০ রান। সেখান থেকে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ২৬১ রানের বেশি করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবু মাশরাফি, মিরাজ, মোস্তাফিজদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে হয় শেষ রক্ষা, মেলে ১৩৭ রানের জয়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে গ্রুপ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। দেশ ছাড়ার আগেই বেশ কয়েকবার টাইগার ক্রিকেটারদের শুনতে হয়েছে দুই আফগান স্পিনার রশিদ খান ও মুজিব উর রহমানকে নিয়ে নানান সতর্কবার্তা, শোনা গিয়েছে ভয়-ভীতির কথাও। সংবাদ মাধ্যমে রশিদ বা মুজিবের ব্যাপারে চিন্তিত না থাকার কথা জানালেও, এ দুই স্পিনারকে নিয়ে চিন্তা করার অনেক কারণ রয়েছে বাংলাদেশের।
কেননা গত জুনে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশ দলের তুলোধুনো হওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিলেন এ দুই বোলার। এছাড়াও আফগানদের ফাস্ট বোলার নাজিবউল্লাহ জাদরান, আফতাব আলমরাও যেকোনো সময় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত।
এমতাবস্থায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই এশিয়া কাপের সুপার ফোর পর্ব নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ দলকে করতে হবে আরও দায়িত্বশীল ব্যাটিং। প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে ব্যর্থ লিটন দাশের কাঁধে থাকবে মহাদায়িত্ব। কেননা আফগানিস্তানের বিপক্ষে তথা টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলোতে দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবালের খেলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় তামিমের পরিবর্তে যেই আসুক না কেন, ইনিংস সূচনা করার যে নেতৃত্ব তা দিতে হবে লিটনকেই।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাকিবের ব্যাটিং নিয়ে কথা বলার জায়গা খুবই অল্প। ইনিংসের প্রথম বলে অমন ডেলিভারি ফেস করাটা যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই দুঃস্বপ্নের মতোই। তবু তামিমের অনুপস্থিতিতে সাকিবের দায়িত্ব বেড়ে যাবে আরও। ৪ ও ৫ নম্বরে মুশফিক ও মিঠুন পাশ করেছেন 'এ প্লাস' নিয়ে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেক।
দলে আরিফুল হক কিংবা সাব্বির রুম্মন না থাকায় শেষদিকে হার্ড হিটিং বা স্লগ করার দায়িত্বটা বর্তায় মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেকের কাঁধেই। দুজনই একসাথে ব্যর্থ হওয়াতেই মূলত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আশানুরূপ সংগ্রহ পায়নি বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে রশিদ, মুজিবদের বোলিং মোকাবেলা করে ব্যাটিং বিপর্যয়ের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বরং শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি ধারালো হতে পারে আফগানদের বোলিং আক্রমণ।
তবে টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই অধিনায়ক মাশরাফি যেমনটা বলেছেন সময় নিয়ে খেললে রশিদ-মুজিবদের বিপক্ষে তেমন অসুবিধা হবে না ব্যাটসম্যান। কিন্তু এই সময় নিয়ে খেলাটাই দেখা যায়নি প্রথম ম্যাচে। লিটন, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেক মিলে খেলতে পেরেছিলেন মাত্র ১৪টি বল। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই ব্যাটিং ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে বেশ খারাপ কিছুই অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ দলের জন্য।
এসএএস/জেআইএম