একজন মানুষের চরিত্রে যতগুলো দোষ থাকা সম্ভব, তার সবগুলোই আছে। সেগুলো না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তার মত একজন দ্বিধাগ্রস্ত, দোদুল্যমান মানুষ কিভাবে ৯ বছর দেশ শাসন করলেন; তা নিয়ে আমার বিস্ময় এখনও কাটে না।
Advertisement
বলছিলাম সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের কথা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও, সংক্ষেপে সিএমএলএ। তার চরিত্র এমনই পেন্ডুলামের মত, সবাই বলতো- ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট।
ক্ষমতায় থাকতে এরশাদের এই দোদুল্যমানতাটা অত প্রকাশ্য ছিল না। কিন্তু প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর তার পেন্ডুলাম চরিত্র প্রকাশ হয়ে যায়। আজ এখানে তো কাল ওখানে। জাতীয় পার্টির আসলে নিজস্ব কোনো আদর্শ নেই।
ক্ষমতায় থাকতে এরশাদ অনেক ভণ্ডামি করেছেন। একাত্তরে এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচারের জন্য গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান। কিন্তু ক্ষমতায় এসে মুখে বললেন, মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান।
Advertisement
আবার এই এরশাদই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবচেয়ে বড় আঘাতটি করেছিলেন। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খায়। কিন্তু এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে রাষ্ট্রের মূল কাঠামোয় আঘাত করেছেন। বিষয়টি এত স্পর্শকাতর, অন্য কোনো সরকারের পক্ষেই সে ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
জনগণের সাথে যোগাযোগ ছিল না। তাই ধর্মকে পুঁজি করেই রাজনীতিতে ঠাঁই খুঁজতে চেয়েছিলেন আগাপাশতলা এই ভণ্ড। শুক্রবার দুপুরে কোনো মসজিদে হাজির হয়ে বলতেন, কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি, এই মসজিদে জুমার নামাজ পড়ছি। অথচ এরশাদের সেই স্বপ্নের কথা এক সপ্তাহ আগেই জেনে যেতো তার নিরাপত্তা কর্মীরা।
অনেকে বিশ্বাস করেন জিয়াউর রহমান হত্যার মাস্টারমাইন্ড এরশাদ। কৌশলে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করে ক্ষমতার পথ কণ্টকমুক্ত করেন এরশাদ। আর ক্ষমতায় এসে জিয়ার স্টাইলে দফা, জোট করে গঠন করেন জাতীয় পার্টি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'যাত্রা পার্টি' হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জাতীয় পার্টির যতটুকু আদর্শ, তা বিএনপির কাছাকাছি। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পর কখনো আওয়ামী লীগ তো, কখনো বিএনপি। নিজের আদর্শে কখনো স্থির থাকতে পারেননি তিনি, বিশ্বস্ত হতে পারেননি কারো প্রতিই। তাই তাকেও কেউ বিশ্বাস করে না, সবাই তাকে ব্যবহার করতে চায়।
Advertisement
ক্ষমতা হারানোর পর ৫ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে এরশাদকে। পরে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। তার দলের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রী হন। বেগম খালেদা জিয়া তাকে ৫ বছর কারাগারে রেখেছিল, এই ক্ষোভের কথা বলতে থাকেন সকাল-বিকাল। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি বেশিদিন বিশ্বস্ত থাকেননি তিনি। চলে যান বিএনপি শিবিরে।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন এরশাদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় এরশাদকে নিয়ে দুই দলে প্রবল টানাটানি, নাটক। হাওয়া বুঝে এরশাদ আওয়ামী লীগের সাথেই ভিড়ে যান। তারপর থেকে এরশাদ আওয়ামী লীগের সাথেই আছেন।
খুব যে মনের আনন্দে আছেন, তা নয়। এরশাদকে পোষ মানানোর মূল অস্ত্র মঞ্জুর হত্যা মামলা। এরশাদ বেশি মোচড়ামুচড়ি করলে মঞ্জুর হত্যা মামলার একটা তারিখ পড়ে। ব্যস এরশাদ আবার ঠাণ্ডা। এরশাদ আসলে ক্ষমতার সাথে থাকতে চান। আর যাতে কারাগারে যেতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চান।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদকে নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে। এমনকি তিনি আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের সময়টা কাটিয়েছেন সিএমএইচে। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে গেছেন। বেরিয়েছেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে। বিরোধী দলেও আছে, সরকারেও আছে। এই সময়ে এরশাদ অনেক হম্বিতম্বি করেছেন, দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু নিজে পদত্যাগ করেননি। বোঝা যায়, তার সব কথাই বাতাসে তরবারি চালানো।
একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবার এরশাদের হম্বিতম্বি শুরু হয়েছে। জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে, ক্ষমতায় আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছেন। সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে। আর বিএনপি এলে মহাজোটের হয়ে নির্বাচন করবে।
এরশাদ ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের কাছে ১০০ আসন আর ১০/১২টি মন্ত্রণালয় চেয়ে রেখেছে। তবে সূত্রমতে তলে তলে এরশাদ বিএনপির সাথেও যোগাযোগ রাখছেন। বিএনপির কাছে তার আসল দাবি, রাষ্ট্রপতি পদ। নির্বাচনকালীন সরকার হলেই নাকি এরশাদের আসল রূপ দেখা যাবে। এরশাদের যা অতীত, তাতে নির্বাচন এলেই তিনি নিজের দর বাড়ানোর চেষ্টা করবেন, এটাই বাস্তবতা।
এরশাদের মত একজন পতিত স্বৈরাচার আর বহুরূপী নেতাকে নিয়েও টানাহ্যাচরা করতে হয়; এটাই আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় অন্ধকার। এরশাদকে দেখে খালি আমার বার বার নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতার লাইন মনে আসে, 'এতই যদি দ্বিধা, তবে জন্মেছিলে কেন?'
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
এইচআর/জেআইএম