খেলাধুলা

চিড় ধরেছে পাঁজরে, বিশ্বাসে নয়

ইনিংসের ১৯তম ওভারে বল করতে আসলেন লংকান অফস্পিনার ধনঞ্জয় ডি সিলভা। ওভারের তৃতীয় বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে বোলারের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকালেন মুশফিকুর রহীম। ম্যাচে তার প্রথম ছক্কা। কিন্তু ছক্কা মেরে প্রশান্তির বদলে খানিক অস্বস্তিই দেখা গেল মুশফিকের চেহারায়। হাত দিয়ে চেপে ধরেন পাঁজরের দিকটা। হালকা ব্যথা অনুভব করেছেন হয়তো।

Advertisement

ক্যারিয়ার সেরা, বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা, এশিয়া কাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা ও দুবাইয়ের মাঠের সর্বোচ্চ ইনিংসটি খেলার পথে মুশফিক ছক্কা মারেন আরও তিনটি। প্রতিবারই বড় শট খেলার পরে তার চোখে-মুখে অস্বস্তির ছাপটা ছিল স্পষ্ট। অবশ্য থাকবেই না কেন!

পাজরে চিড় ধরার খবর জেনেও যে ব্যাট করতে নেমেছেন। বড় শট খেলতে সমস্যা হবে সেটিও জানতেন মুশফিক। এর সাথে ছিল দুবাইয়ের প্রচণ্ড উষ্ণ আবহাওয়া। এতসব প্রতিকূলতা জয় করেই ১৫০ বলের দুর্দান্ত ইনিংসে ক্যারিয়ার সেরা ১৪৪ রান করেন ডানহাতি এ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশের ১৩৭ রানের বিশাল জয়ে নির্বাচিত হন ম্যাচসেরা।

এশিয়া কাপের স্কোয়াড ঘোষণার আগেই অনিশ্চয়তা ছিলো সাকিব আল হাসানের খেলার ব্যাপারে। বিশ্বসেরা এ অলরাউন্ডার জানান দলের প্রয়োজনে এশিয়া কাপটাও উইন্ডিজ সফরের মতো ইনজেকশন নিয়ে খেলে দেবেন তিনি। তাকে নিয়েই ঘোষণা করা হয় এশিয়া কাপের স্কোয়াড।

Advertisement

দেশ ছাড়ার আগে ভিসা জটিলতায় আটকে যান তামিম ইকবাল। দল চলে গেলেও তিনি থেকে যান দেশে। ভিসা সংক্রান্ত সমস্যা কাটিয়ে দুই দিন পরে যোগ দেন দলের সাথে। কিন্তু মাঝের এই দুই দিনে মিরপুরে স্বেচ্ছা অনুশীলন করতে গিয়ে বাঁ হাতে ব্যথা পান তামিম। প্রধান নির্বাচক জানান চিড় ধরা পড়েছে তামিমের হাতে। তবু খেলতে প্রস্তুত জানিয়ে দেন দেশসেরা এ ওপেনার।

প্রথম ম্যাচে নেমে যান খেলতে কিন্তু উইকেটে থাকা হয় মাত্র ১২ বল। সুরাঙ্গা লাকমলের বাউন্সারে হুক করতে গিয়ে আবারও লাগে সেই ব্যথাযুক্ত আঙুলে। মাঠ ছেড়ে যান মাত্র ৩ বল মোকাবেলা করে। চলে যেতে হয় হাসপাতালে, সেখানে স্ক্যান করে ডাক্তার হাত ঝুলিয়ে দেন কাঁধে।

বাংলাদেশ ইনিংসের ৪৭তম ওভারে মোস্তাফিজুর রহমান রানআউট হলে সবাইকে অবাক করে নেমে যান মাঠে। এক হাতেই মোকাবেলা করেন লাকমলের কোমড় উচ্চতার এক ডেলিভারি। তামিমের এই সাহসিকতার সুত্র ধরে মুশফিক শেষ উইকেট এ জুটিতে করেন ৩২ রান। যার কৃতিত্ব প্রাপ্য তামিমেরও।

Advertisement

সাকিব-তামিমের অনিশ্চয়তার মাঝে ম্যাচ শুরুর আগে দেখা দেয় নতুন এক শঙ্কা। দলের ভেতর থেকে চাপা খবর আসতে থাকে শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে ম্যাচে খেলতে পারবেন না পঞ্চপান্ডবেন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মুশফিকুর রহীম। শুধু তাই নয় গুঞ্জন শোনা গেছে দেশে ফেরার বিমানে চাপতে হবে মুশফিককে।

টিম ম্যানেজম্যান্টের পক্ষ থেকে ম্যাচের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি এ বিষয়ে। কেননা প্রতিপক্ষের জন্য এ খবরটি হতে পারতো বোনাস পয়েন্ট। দলের মধ্যে সংশয় থাকলেও নিশ্চিত ছিলেন মুশফিক। জানিয়ে দেন প্রয়োজনে বুকে-পাঁজরে টেপ পেঁচিয়েই খেলে দেবেন প্রথম ম্যাচটা। কেননা অধিনায়ক, কোচসহ সবাই বারবার বলেছেন টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ দলের জন্য।

পরে ম্যাচে শুধু খেলেননি মুশফিক, জিতেছেন নিজে, জিতিয়েছেন দলকে। পাঁজরের চিড় নিয়েই ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই নেমে পড়তে হয় মাঠে। উইকেটে থাকেন শেষ ওভারের তৃতীয় বল পর্যন্ত। বড় শট খেলতে সমস্যা হবে বিধায় শুরুতে ইনিংস সাজান সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে।

কিন্তু বর্তমান সময়ে সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে কি আর বেশিদূর যাওয়া যায়! তাই বড় শট খেলতে শুরু করেন মুশফিক। প্রতিটা শটের পরেই দেখা যায় কেমন কুকড়ে যাচ্ছেন মুশফিক। ১৫০ বলে ইনিংসে বলকে ১৫ বার (১১ চার ও ৪ ছক্কা) বাউন্ডারি ছাড়া করেন তিনি।

ইনিংসের মাঝপথেই পাঁজরের ব্যথার সাথে যুক্ত হয় ক্র্যাম্প। দুবাইয়ের অত্যধিক গরমে টান লাগে পায়ের পেশিতে, সমস্যা হয় দৌড়াতে। তবু থামানো যায়নি মুশফিককে। ইনিংসের ৪৭তম ওভারে ভাঙা হাত নিয়েই তামিমের নেমে পড়া দেখে যেন বাড়তি সাহস পেয়ে যান তিনি। ভাবতে শুরু করেন ভাঙা হাত নিয়ে তামিম পারলে, আমি কেন নয়!

৪৭তম ওভারের শেষ বলটা এক হাতেই খেলে দেন তামিম। শেষ উইকেটের এ জুটি পরে খেলে আরও ১৫টি বল। সবক'টি মোকাবেলা করেন মুশফিক। বড় শট খেলতে সমস্যা থাকা স্বত্বেও এই ১৫ বলে তিনটি করে চার-ছক্কার মারে ৩২ রান তোলেন মুশফিক। তামিমের সাথে দশম উইকেট জুটির এ ৩২ রানই এগিয়ে দেয় বাংলাদেশকে।

এগিয়ে যাওয়াটা কেবল সংখ্যার বিচারে নয়। ৫০ ওভারে ২৬১ রান হয়তো বিশাল কিছু নয়, শেষ উইকেটে ৩২ রানের জুটিও হয় হরহামেশাই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ভাঙা হাতে তামিমের নেমে পড়া, পাজরে চিড় নিয়েও মুশফিকের লড়াই করা যেন জানান দিচ্ছিল, টাইগারদের চিড় ধরেছে পাঁজরে বা হাতে, বিশ্বাসে নয়! এ বিশ্বাসের জোর ধরেই বিদেশের মাটিতে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়টি তুলে নেয় মাশরাফি বাহিনী।

এসএএস/এমএস