একাকিত্ব, আবেগ, কষ্ট, উদাসীনতা, নীরবতা কান্নার অপর নাম প্রবাস জীবন। অনুভূতিগুলো ধারণ করাও কারো পক্ষে সম্ভব না। প্রবাস জীবনে প্রবাসীরাই এগুলো বেশি অনুভব করে। এখানে কেউ দুঃখ পায় না, কারণ দুঃখ পেতে আপনজন প্রয়োজন হয়।
Advertisement
প্রবাস মানে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ, শুধু অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনা নয়, জীবিকা ও জীবনের তাগিদে, সোনালি স্বপ্নের হাতছানিতে মানুষ প্রবাসী হয়। হাজার কষ্ট মেনে নিয়েও দেশে প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটাতে চায়।
‘ভেবেছিলাম ইউরোপের জীবন কতইনা সুখের। এখানে এসে বুঝলাম কষ্ট কাকে বলে। প্রবাসীর কষ্ট একজন প্রবাসীই ভালো জানেন। অন্য কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। পরিবার-পরিজন যেন ভালো থাকতে পারে এই চিন্তা মাথায় রেখেই আমাদেরকে প্রতিনিয়তই অভিনয় করতে হয়। সুখের হাসি হেসে বলতে হয় ‘আমি ভালো আছি মা, ভালো আছি বাবা।’ কথাগুলো বলছিলেন সিসিলি প্রবাসী জাহিদ হাসান। ছেলেটির বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর।
দেশটি ইতালীয় উপদ্বীপের দক্ষিণে, ভূমধ্যসাগরের মাঝ বরাবর অবস্থিত, যা মূল ভূখণ্ড থেকে মেসিনার সংকীর্ণ স্ট্রেইট দ্বারা পৃথক হয়েছে। মূলত সিসিলিতে স্থাপনা, স্বচ্ছ সাগরের পানি, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য রয়েছে।
Advertisement
জাহিদ বলেন, ‘প্রথমে আমি মালয়েশিয়াতে ছিলাম। সম্প্রতি দেশটিতে অবৈধদের ধরপাকড়ের কারণে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হই। বাড়িতে প্রায় ৮ মাস অবস্থান করি। এরপর বাড়িতে থেকেও অশান্তি। লোকজন বলে বিদেশ গিয়ে কি করলি।
বাড়ির লোকজনও আমাকে নিয়ে কটূক্তি করে। এতদিন মালয়েশিয়ায় থেকে কিছুই তো করতে পারলি না। বাড়িতে ৮টি মাস খুব কষ্টে কেটেছে।’ মানুষের আবোল-তাবোল কথা সহ্য করতে না পেরে আবার সিদ্ধান্ত নিই বিদেশ যাবার। কিছু করার।
তিনি বলেন, ‘গোপনে গোপনে সিদ্ধান্ত নিলাম ইতালির সিসিলি যাব। শুনেছি ওখানে টাকার মান বেশি। এরপর যোগাযোগ শুরু করে দিলাম আদম দালালের সঙ্গে। দালাল জানাল কোনো ব্যাপার নয়। পাঠিয়ে দেব তবে ৩ লাখ লাগবে। আমিও রাজি হলাম। জমি-জামা যেটুকু ছিল বিক্রি করে দালালকে টাকা দিই।’
এ পরবাসী বলেন, ‘টাকা দেয়ার মাসখানেক পর খবর আসলো সব প্রসেস কমপ্লিট। দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেল। নিয়মমাফিক চলে গেলাম সিসিলিতে। দেশটিতে আসার পর বুঝলাম বাড়িতেই ভালো ছিলাম। কারণ এখানে কাজের কোনো হিসেব নেই। মালিকের যখন ইচ্ছা আমাকে দিয়ে ডিউটি করিয়ে নেয়। ঘুমের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ঠিকমতো খাওয়ার সময়ও দেয় না।’
Advertisement
‘মাস শেষে যে টাকা দেয় তাতে নিজেই চলতে পারি না। বাড়িতে কি পাঠাবো বুঝতে পারি না। নিজেকে সান্ত্বনা দিই নতুন বলে হয়ত এ ধরনের সমস্যা পুরাতন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বাড়িতে নিয়মিত কথাও বলতে পারি না। কারণ মোবাইল বিল অনেক আসে।’
‘এদেশের আইন-কানুন আমার দেশের আইনের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। নিজেকে মানিয়ে নেয়া কষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ভিন্ন ভাষা আয়ত্ত করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রবাসী জীবন কারো কারো জন্য খুবই সুখের ও নিরাপদ আবার কারো কারো জন্য দুঃখের ও কষ্টের।’
‘শত যন্ত্রণার জাঁতাকলে পিষ্ট হতে দেখেছি কত স্বপ্নকে। হতাশা আর না পাওয়ার যন্ত্রণায় কত প্রাণের যে নিঃশব্দে পতন ঘটতে দেখেছি এই চোখে, তা বলে শেষ করা যাবে না।’
পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ একটি বিস্ময়কর জীবনের অধিকারী হতে চায়। মানুষ যা ভালোবাসে, যা আশা করে, তা পেতে চায়। কিন্তু সব সময় কি তা পাওয়া হয়ে উঠে? মানুষের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে বিস্তর ব্যবধান। এ ব্যবধান কিছু শ্রষ্টা প্রদত্ত আবার কিছু মনুষ্যসৃষ্ট।
জাহিদ বলনে, ‘প্রত্যেক মানুষই তার আপন পরিবার, পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে সুখের কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে থাকতে চায়। এ চাওয়া কি অন্যয়? প্রত্যেকেই সুখের জীবন গড়তে অজস্র ধন-সম্পদের অধিকারী হতে চায়। কিন্তু সবাই কি সফল হয়? সফল হতে না পারলে তখন জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ ও যন্ত্রণাময়। তাই মাঝে মাঝে ভালবাসাকে অহেতুক মনে হয়। এ পৃথিবীতে কোনো জিনিস ভালোবাসলে ভালোবাসাতেই যে তার চরম ও পরম সার্থকতা, এটা বোধহয় কোন প্রবাসী ছাড়া বুঝতে পারে না।’
আজ প্রবাসে একাকী নির্জন রাতের আকাশে হাজার তারার ভিড়ে আজও হারিয়ে বন্ধুদের শূন্যতা অনুভব করি। প্রকৃত বন্ধুদের শূন্যতা প্রতি মুহূর্তে আহত করে প্রবাসী মন। ভরা সন্ধ্যায় উতলা হাওয়ায় মন ছুটে যায় বন্ধুদের খোঁজে। তখন আমার এলোমেলো ভাবনাগুলো ক্লান্ত হয়ে মিশে যেতে চায় হারানো অতীতে। সময়ের পরিবর্তনে মনও বদলে যায়, বদলে যায় ধ্যান-ধারণা।
এমআরএম/আরআইপি