দেশজুড়ে

ভাঙছে পদ্মা, ঝুঁকিতে বঙ্গবন্ধু সিলিকন সিটি

উজানের ঢলে প্রমত্তা পদ্মায় বান ডেকেছে। ছুঁই ছুঁই করছে বিপদসীমা। নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে পদ্মাপাড়ে নির্মাণাধীন রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু সিলিকন সিটি।

Advertisement

নগরীর রাজপাড়া থানার নবীনগর মৌজার ৩১ দশমিক ৬৩ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠছে ‘বঙ্গবন্ধু সিলিকন সিটি’। ২৮১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির আদলে গড়ে উঠেছে এটি।

সীমানা প্রাচীরসহ পার্কের দশতলা বিশিষ্ট এমটিবি ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের জুন থেকে। গত বছরের ১৪ সেটেম্বর রাজশাহীর এক জনসভায় এসে এ কাজের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি শেষ হলে এখানে তথ্য প্রযুক্তিখাতে প্রশিক্ষণ ও কর্মস্থানের সুযোগ পাবে প্রায় ১৪ হাজার তরুণ-তরুণী।

বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রকল্পের পরিচালক এসএম আবুল কাশেম জানিয়েছেন, এখন রাস্তা এবং ড্রেন নির্মাণকাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ। এই অর্থ বছরেই বাকি কাজেরও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হবে। এ অর্থবছরেই দৃশ্যমান হবে পুরো প্রকল্প।

Advertisement

তবে স্থানীয়রা বলছেন, প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানটি নগরীর নিম্নতম জিয়ানগর বলে পরিচিত। প্রতি বছর বন্যায় এ এলাকা প্লাবিত হত। প্রকল্প শুরু রপর পুরো এলাকা বালি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। প্রকল্পের সীমানা প্রাচীরের প্রায় ২০০ গজের মধ্যেই পদ্মা। গত বন্যায় আশপাশের এলাকায় নদী ভাঙন হয়েছে।

তবে এরই মধ্যে ওই এলাকায় পদ্মার ৫ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ কাজ শেষ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু উজানের ঢলে নদীর পাড় এখন উপচে পড়ার দশা। ভাঙন দেখা দিলে ঝুঁকিতে পড়বে পুরো স্থাপনা। এতেই নতুন করে দানা বাঁধছে আতঙ্ক।

তবে আতঙ্কের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা পদ্মার পাড় বেঁধে দিয়েছি। এটি প্রাথমিক সুরক্ষা। গ্রোয়েনগুলোও শক্তিশালী করছি, সেটা দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

আবার নদী ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ৬ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হবে। আগামী শুকনো মৌসুমেই সেটিও শেষ হয়ে যাবে। আমরা মনে করি, এ তিনটি কাজ শেষ হলে নদীর সুরক্ষাকাজ সুদৃঢ় হবে।

Advertisement

তবে নদী পাড় বেঁধে কিংবা সামান্য একটি অংশ ড্রের্জিং করে নদী শাসন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সরোয়ার জাহান সজল।

তিনি বলেন, পদ্মা নদীর যে অংশে এটি নির্মাণ হচ্ছে, সেটি স্বাভাবিকভাবে বন্যা এবং নদী ভাঙনের ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা। নদী যদি সামনের অংশটুকু ড্রেজিং করা যায়, তাহলে বর্ষাকালে পলি এসে আবারও তলদেশ ভরাট হয়ে যাবে। এতে আগের অবস্থায় ফিরে যাবে নদী। এই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে নদী সুরক্ষা। এতে নদীর পুরো তীর নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে গবেষণার পর টেকশই পরিকল্পনায় যেতে হবে।

অধ্যাপক ড. সজল সরকারের পানিবিষয়ক ট্রাস্কফোর্সের সদস্য। কিন্তু সরকারের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ট্রাস্কফোর্সের কোনো পরামর্শ নেয়া হয়েছে কি-না তা জানাতে পারেননি এই অধ্যাপক।

এদিকে, সম্প্রতি চীনে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে চীন ও ভারতের এই নদী অববাহিকায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। এর প্রভাবে বান ডেকেছে পদ্মায়ও। বন্যায় দিল্লী সতর্ক করেছে ঢাকাকে। এরপর রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জরুরি ফ্যাক্স বার্তা পাঠিয়ে স্থাপনা রক্ষা সর্তক থাকার নির্দেশ দিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে সর্তক রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড।

অন্যদিকে, দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠছে পদ্মা। উজানের ঢলে এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা তীরবর্তী চর এলাকাগুলো। দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন।

বিশেষ করে রাজশাহী শহরের ওপারের পদ্মার চর খিদিরপুর, গোদাগাড়ীর চর আষাড়িয়াদহ বাঘার চকরাজাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কোদালকাটি, শিবগঞ্জের পাকা নারায়নপুর ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে ব্যাপক বন্যা।

পানিবন্দি হয়ে রয়েছে হাজারো মানুষ। পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বসতবাড়ি, বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটবাজারসহ বহুস্থাপনা। নদীতে চলে গেছে ফসলি জমি। মানবিক সহায়তা নেই বললেই চলে। এতে অসহায় জীবনযাপন করছেন দুর্গতরা।

ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে এলাকার হাজারো পরিবার। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে বিজিবির বিওপি, বিদ্যালয়, মসজিদ, হাট-বাজার, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বহু স্থাপনা।

এদিকে, রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নগরীর বড়কুঠি স্ল্যান্টিং গেজ পাঠক এনামুল হক জানিয়েছেন, রাজশাহীতে পদ্মায় বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। গত ১ আগস্ট পদ্মায় প্রবাহ ছিল ১৪ দশমিক ৭১ মিটার। বাড়তে বাড়তে ১১ আগস্ট তা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩৬ মিটারে। ৩১ আগস্ট পদ্মায় প্রবাহ দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩৯ মিটার।

এরপর প্রতিদিনই বেড়েছে পদ্মায় প্রবাহ। গত ১ সেপ্টেম্বর ১৬ দশমিক ৫২ এবং ৬ সেপ্টেম্বর ১৭ দশমিক ১৬ মিটারে বয়েছে পদ্মা। সর্বশেষ বুধবার ২৪ ঘণ্টায় প্রবাহ বেড়েছে ১ সেন্টিমিটার। ১২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টায় পদ্মায় প্রবাহ ছিল ১৭ দশমিক ১৭ মিটার।

এ বিষয়ে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, চীনে বন্যার তথ্য আমাদের কাছে আছে। যে কোনো ধরনের বন্যা মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত। যেসব স্থাপনা আমাদের আছে সেগুলো বন্যায় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে রক্ষা করা যায়-এমন প্রস্তুতিও আমাদের যথেষ্ট আছে।

এমএএস/জেআইএম