বিনোদন

হতাশায় শোবিজ ছেড়ে বিদেশমুখী তারকারা

নব্বই দশক ছিল ছোটপর্দার সোনালি যুগ। চ্যানেল ছিল একমাত্র বিটিভি। এই চ্যানেল ঘিরেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে শতাধিক তারকার। যেমন ব্যস্ত ছিলেন আফজাল হোসেন, হুমায়ূন ফরীদি, সুবর্ণা মুস্তাফা, খালেদ খান, তারিক আনাম খান, আব্দুল কাদের, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, তৌকীর আহমেদ, বিজরি বরকতউল্ল্যাহ, আজিজুল হাকিমরা। তেমনি ব্যস্ত ছিলেন সেই সময়ের নতুন মুখ মীর সাব্বির, লিটু আনাম, টনি ডায়েস, দীপা খন্দকার, তারিন, সুইটি, মাহফুজ আহমেদের মতো তারকারা।

Advertisement

ব্যস্ততায় দিন পার করতেন নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকাররাও। তারকাবহুল অনুষ্ঠানগুলো দর্শকদের বিনোদনের মূল আশ্রয় ছিল। হুমায়ূন আহমেদের মতো নির্মাতাদের নাটকগুলোতে দেখা যেত তারকাদের ছড়াছড়ি। ধারাবাহিক হলে তো কথাই নেই। একই ফ্রেমে দেখা মিলতো আবুল হায়াত, দিলারা জামান, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, আজিজুল হাকিম, আসাদুজ্জামান নূর, আব্দুল কাদের, লাকী ইনাম, আলী যাকেরদের।

কিন্তু চ্যানেলের এই রাজত্বেও সেসব দৃশ্য এখন স্বপ্নের মতোই। স্যাটেলাইটের এই যুগে অর্ধশতাধিক চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে নিয়মিত। নাটক-টেলিছবিরও কমতি নেই। কিন্তু শোবিজে বেকারত্ব বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবেই।

ঘুরে ফিরে প্রায় সব নাটকেই দেখা মিলছে চেনা মুখ। বৈচিত্র নেই যেমন গল্প-চরিত্রে, তেমনি বৈচিত্র নেই শিল্পী মুখেও। ফলে হাতেগোনা কয়েকজন বাদে ছোটপর্দার বেশির ভাগ শিল্পীর মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

Advertisement

বাধ্য হয়েই অনেকে বিকল্প পেশা খুঁজছেন। শহীদুল আলম সাচ্চু, শামস সুমন, সুবর্ণা মুস্তাফার মতো তারকাদের কেউ কেউ রেডিও-টেলিভিশনে নিয়মিত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। কেউ আবার বন্যা মির্জার মতো সংবাদপত্রের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছেন। লাক্স সুন্দরী মেহরিন ইসলাম নিশার মতো কেউ কাজ করছেন ব্যাংকে। অনেকে চাকরি নিয়েছেন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। কেউ নেমেছেন ফ্যাশন হাউস ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়।

অনেকেই হতাশা নিয়ে, অভিমান নিয়ে দেশ ছাড়ছেন। চেষ্টা করছেন বিদেশে স্থায়ী হতে। কয়েক বছরের সেই দৃশ্যটা চলতি বছর বেড়েছে। তারকাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডাতেই চোখ বেশি তারকাদের।

এসব তারকার মধ্যে রয়েছেন মোনালিসা, মিলা হোসাইন, তিন্নি, শিরীন বকুল, রোমানা, শায়না আমিন, আমব্রিন, নাফিজা জাহান, ঈশিকা খান, রিচি সোলাইমানদের নাম। এদের মধ্যে মোনালিসা, মিলা, রিচি, ঈশিকা মাঝে মধ্যেই দেশে আসেন। বিশেষ করে ঈদের মতো উৎসবগুলোতে দেখা মেলে তাদের। এসে নাটক-টেলিছবি ও বিজ্ঞাপনে কাজ করে আবার ফিরে যান। শোবিজের অনেকেরই কাছে তারা শীতের পাখি বলে পরিচিত।

তারা যে ক্যারিয়ারের ভাটায় বিদেশমুখী হয়েছেন তা কিন্তু নয়। অনেকেই বিয়ে করে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছেতেই বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সংসারি হতেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন দেশ ও প্রিয় শোবিজ থেকে।

Advertisement

এ তালিকায় আছেন অভিনেতা ও বাংলাভিশনের সাবেক অনুষ্ঠান প্রধান শামীম শাহেদ, নির্মাতা সায়ীদ জামিম, সাইফুল ইসলাম মান্নু, কামরুল হাসান প্রমুখ।

নতুন করে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন তমালিকা কর্মকার। অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হচ্ছেন তিনি, এমনটাই শোনা যাচ্ছে। তার মতোই বিদেশে স্থায়ী হতে চলেছেন আরেক অভিনেত্রী নাদিয়া আহমেদ।

সূত্রের খবর, অনেকদিন ধরেই এই নৃত্যশিল্পীর পরিবারের অনেক সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। এবার তিনিও যোগ দিচ্ছেন। তার সঙ্গে স্বামী নাঈমও সঙ্গী হচ্ছেন। বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন উপস্থাপিকা ও অভিনেত্রী নওশিনও।

তবে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চিত্র তারকাদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা অনেকদিন ধরেই রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই স্থায়ী আবাস গড়েছেন স্বপরিবারে। চিত্রনায়িকা রোজিনা থাকেন যুক্তরাজ্যে। ববিতারও অনেকটা সময় কাটে কানাডাতে, একমাত্র ছেলের সঙ্গে। তারা কালেভদ্রে দেশে আসেন, আবার ফিরে যান।

সম্প্রতি ২২ বছর পর দেশ ঘুরে গেলেন কলকাতায় স্থায়ী হওয়া এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা অঞ্জু ঘোষ। তার মতো আরেক নায়িকা সুনেত্রাও অনেকদিন ধরে কলকাতাতেই স্থায়ী নিবাস গড়েছেন। একযুগেরও বেশি সময় যাবৎ স্থায়ীভাবে কানাডাতে বসবাস করছেন জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা আরিফুল হক। আমেরিকাতে চাকরি করেন একসময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা বিপ্লব।

অনেকদিন দেশে আসেন না চিত্রনায়িকা সোনিয়া। ক্যারিয়ারে সুবিধা না করতে পেরে যুক্তরাজ্যে স্থায়ী হয়েছেন। সোনিয়া নামে ক্লোজআপ ওয়ান খ্যাত এক গায়িকাও বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন।

ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী আবাস গড়েছেন টনি ও প্রিয়া ডায়েস দম্পতি। গুঞ্জন রয়েছে, নতুন করে যেসব তারকা যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান তাদের বেশিরভাগই এই দম্পতির সাহায্য চান। অনেকে এই দম্পতির বাড়িতেই অতিথি হতে চান। তবে বিদেশ বিভুঁইয়ে চাইলেই অনেক কিছু করা যায় না। তাই এই দম্পতিকে মাঝে মধ্যেই বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়।

শোনা যাচ্ছে, শোবিজের একাধিক তারকা বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। এখানে পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, অমিত হাসান, ওমর সানী-মৌসুমী দম্পতি, মিশা সওদাগর, বাপ্পী চৌধুরীর মতো তারকারাও রয়েছেন। নিজের ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা। এই তারকাদের তালিকায় আছেন অনেক নাটক-চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক-গীতিকারসহ সংগীতাঙ্গনেরও অনেক তারকা।

অনেকেই তারকাদের বিদেশমুখী হওয়াকে শোবিজের জন্য হতাশা ও আশঙ্কা বলে মনে করছেন। তাদের মতে, এভাবে তারকারা বিদেশে পাড়ি জমালে শোবিজের প্রতি আস্থা হারাবে নতুন প্রজন্ম। অনেকেই এর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোর বিতর্কিত ‘আর্টিস্ট টিআরপি’ রেটিংকে দায়ি করছেন। এই রেটিং পরিচালক ও প্রযোজকদের বাধ্য করে ঘুরে ফিরে একই শিল্পী নিয়ে কাজ করতে। দায় রয়েছে স্বজনপ্রীতি, বন্ধু-বান্ধবী, কাছের মানুষদের প্রতি বাড়তি সুযোগ দেয়ার প্রবণতা, বৈচিত্র্যময় গল্পের অভাব, চরিত্রে বিচিত্রতার সংকটেরও। সেইসঙ্গে নানা সংকটে আক্রান্ত সিনেমাকে দ্রুত চাঙ্গা করারও দাবি উঠছে জোরেশোরে। 

এ বিষয়ে অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব নাসিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমন কিছু খবর আমিও শুনেছি। অনেকেই বিদেশ যাচ্ছেন, অন্য পেশা খুঁজছেন। এর মূলে পেশায় নিরাপত্তার অভাব। পাশাপাশি অনেকে সম্মান বা মূল্যায়ণের অভাবেও শোবিজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন।

আশি-নব্বই দশকে গুটি কয়েক তারকা ছাড়া অন্যরা অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে চাইতো না। তারা থিয়েটার করতো একরকম শখেই বলা যায়। কিন্তু স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিপ্লব যখন শুরু হলো তখন অনেকেই পেশা হিসেবে অভিনয়কে বেছে নিলো। সেখানে এখন অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে।’

এই অভিনেতা আরও বলেন, ‘আমাদের হিসাব মতে প্রায় তিন শতাধিক অভিনয়শিল্পী রয়েছেন যারা অভিনয়কে কেন্দ্র করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু আজকাল নাটক-টেলিছবিতে দেখা যায় মাত্র তিনজনকে নিয়েই গল্প। নায়ক-নায়িকা ছাড়া আর কারোরই গুরুত্ব থাকছে না। সেজন্যই শিল্পীদের বেকারত্ব বাড়ছে। তার প্রভাব পড়ছে নেতিবাচকভাবে। এ বিষয়ে সম্মিলিত ভাবনার প্রয়োজন জরুরি।’

এলএ/এএ/জেআইএম