মতামত

বঙ্গ ঈর্ষায় পাক-ভারত তাজ্জব কী বাত!

বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের আদি রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য ঈর্ষার। ভারতের জন্যও উদ্বেগ ও তাড়নার। সাইজে বড় হলেও ভারতের প্রবৃদ্ধির গতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের গতির কাছে মার খাবার জোগাড় হচ্ছে। আর পাকিস্তান এরইমধ্যে মার খেয়েই গেছে। সেই বেদনায় তাদের এখন বাংলাদেশ হবার শখ।

Advertisement

গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক টাটকা খবর হচ্ছে, পাকিস্তান শান্তির দেশ সুইডেন হতে চায় না। তারা হতে চায় বাংলাদেশ। তাজ্জব খবর। তথ্যের ছহি-শুদ্ধতা এখনই চূড়ান্ত নয়। তবে, শুনতে ভালো না লেগে পারে না। নগদে কানসুখ। কেন নয়? এ অঞ্চলে পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল প্রায় সিকি শতাব্দী। সর্বক্ষেত্রে চলেছে শোষণ। বাঙালি চিত্তবিকার দিতে চাইলে নেমে আসে নিপীড়ন। একপর্যায়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশকে লড়তে হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এ সংগ্রামে জয়ী হতে বিনিময় মূল্য দিতে হয়েছে জীবনে, রক্তে এবং সম্ভ্রমে। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ। ক্ষত-বিক্ষত ভূখণ্ড। অভাব। অর্থনীতিতে রক্তশূন্যতা। স্পর্ধিত উচ্চারণে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি' ।

প্রশ্ন হচ্ছে, এমন খায়েশ কেন চাপলো পাকিস্তানের? কী এর রহস্য? তারা নিজেরাও জানে, একাত্তরের ধ্বংসস্তুপ থেকে বাংলাদেশ নিজেকে তুলে এনেছে। প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বসভায়। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেছে পাকিস্তানকে ডেমকেয়ার করে। তারা দেখছে- সেই বাংলাদেশ আজ এখন ভালো আছে। ভালো করছে। আরো ভালোর চেষ্টাও দৃশ্যমান। অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই চুরি, দুর্নীতি, লুটতরাজসহ অনেক মন্দ খবরে আক্রান্ত বাংলাদেশ। ভালো কত কিছুও তো ঘটেছে ৪৭/৪৮ বছরে। মধ্য-সত্তুরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৮ কোটির মতো। পাকিস্তানে ৭ কোটি। ভূখণ্ডের দিক থেকে আমাদের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বড় পাকিস্তানের জনসংখ্যার চাপ অনেক কম ছিল। আজকে কি অবস্হা? আজ আমাদের জনসংখ্যা ১৬/১৭ কোটি। পাকিস্তানের ২১ কোটি। অনেক কম আয় সত্ত্বেও বাংলাদেশ জনসংখ্যার অশ্বকে বাগে এনেছে। তা অভাবনীয় দৃষ্টান্ত।

পাকিস্তানের অন্যতম গর্বের জায়গা প্রবৃদ্ধির হার আর উচ্চ মাথাপিছু আয়েও ফাটল ধরেছে। হালনাগাদ তথ্য বলছে, ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। বাজার বিনিময় ডলার মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১,৫৩৮ মার্কিন ডলার, আর পাকিস্তানের ১,৪৭০ মার্কিন ডলার। গত দশবছরে বাংলাদেশে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশের মতো। পাকিস্তান তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। আপাতত সেই নমুনাও নেই। সামাজিক বিষয়েও বেশ কিছু অগ্রগতি রয়েছে বাংলাদেশের। আমাদের গড় আয়ু ৭২ বছর। আর পাকিস্তানের ৬৬। অর্থাৎ ৬ বছর কম। শিশু মৃত্যুর হার আমাদের প্রতি হাজারে ৩১, পাকিস্তানে ৬৬। আমাদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশে মেয়েদের ৪২ শতাংশের মাধ্যমিক শিক্ষা রয়েছে। সেখানে পাকিস্তানের সাকুল্যে ২০ শতাংশ। শুধু পরিমাণগত নয়, গুণগত দিকেও বিস্তর অর্জন বাংলাদেশের ।

Advertisement

পোশাক শিল্পসহ আরো কয়েকটি খাতে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সুনাম ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা প্রশংসিত। হাইতি, দক্ষিণ সুদান, পূর্ব তিমুরে বাঙালি শান্তিরক্ষীরা বিশ্বস্ততা, নিরপেক্ষতা ও মানবিকতার প্রতীক। বাংলাদেশ যখন উঁচুতে ওঠার চেষ্টায়, সেখানে পাকিস্তান শুধু নিচে নেমেছে। দেশটিতে আল-কায়দা গেড়ে বসেছে। ছড়িয়ে পড়েছে মৌলবাদী সন্ত্রাস। সমাজে সামন্তবাদ আরো জোরালো হয়েছে। আরো বেড়েছে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি বৈষম্য। আর আঘাতে আঘাতে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে খান খান। এ রকম অবস্থায়ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় নাটকীয় আগমন ইমরান খানের। নিজদেশের হালহকিকত বলতে গিয়ে বাংলাদেশের আয়-উন্নতির উদাহরণ দিয়েছেন তিনি।

পাকিস্তানের লেখক-কথকরাও বাংলাদেশের উদ্বৃতি দিচ্ছেন বেশি বেশি। জানাচ্ছেন জেলাসির কথা। বিশেষ করে টেলিভিশন টক শোতে। বাস্তবতার এ কঠিন অবস্থায় সবকিছু মিলিয়ে পাকিস্তান তো বাংলাদেশ হতে চাইবেই। আবার পাকিস্তান চাইলেই বাংলাদেশ হতে পারবে কি না, সেটা বহু পরের ব্যাপার। তবে, বাংলাদেশ অবশ্যই কখনো পাকিস্তান হতে চাইবে না। তাই বলে বাংলাদেশ কি প্রতিবেশি ভারত হতে চাইবে? সম্ভবত এ প্রশ্নের জবাবও ‘না’ সূচকই হবে। গণতান্ত্রিক শাসন ও বিধিব্যবস্থায় ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের ওপরে। এ নিয়ে সন্দেহ বা বিতর্কের কিছু নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক সূচক বাংলাদেশের চেয়ে ততো জোরদার নয়। কিছু কিছু সূচকে বরং কমজুরি।

বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রীর আশা চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। তখন প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ভারতের অর্থবছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে অর্জন ৮ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এবং প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে ভারতের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি চলে যাবে। কিছু তবে, কিন্তু, যদি থাকলেও সরকারের সমালোচক অর্থনীতিবিদদেরও এ নিয়ে তেমন মতভেদ নেই। ভারতের অর্থনীতির সাইজের কাছাকাছি যেতে বাংলাদেশকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে- এ নিয়েও মতভিন্নতা নেই। ভারতে চলতি অর্থবছরে জিডিপির লক্ষমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ভারত লক্ষমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করেছে।

বিগত অর্থবছরগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থবছরের শুরুতে ভারতের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি থাকে। কিন্তু বছর শেষে এসে সেই ধারা হারিয়ে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চরিত্র উল্টো। এখানে অর্থবছর শুরুর দিকে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম থাকে। বাড়ে বছর শেষে। সেই হিসেবে এই বছরই ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা বাংলাদেশের কারো কারো। এ রকম আশাবাদের পেছনে কিছু যুক্তি ও বাস্তবতাও রয়েছে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই ডাঙ্গর হচ্ছে। অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার বেশিরভাগ চাকা এখন সচল। অনেক মেগা প্রজেক্ট চলছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সাল নাগাদ এর প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিট ছুঁতে পারে। বছর দশেক আগে, ভারতের সাথে আমাদের যে পার্থক্য ছিল, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সুফল হিসেবে সেটা দূর হয়ে এখন প্রতিযোগিতামুখর।

Advertisement

বিগত তিন বছরের দুই দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ অন্যদিকে ভারতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখলেও ভারতের পালে ভাটা লাগে। আলোচ্য অর্থবছরে ভারত যেখানে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সেখানে বাংলাদেশ অর্জন করে রেকর্ড ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। দুই দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় দেখা যায়, ভারত সরকার ২০২২ সাল নাগাদ তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উক্ত সময়ে তাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা ৯ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। আর আইএমএফের হিসাব-নিকাশ বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ ভারতের জিডিপির প্রবৃদ্ধি থাকবে ৮ শতাংশের নিচে।

এ বাস্তবতায় বাংলাদেশকে ভারতের হিংসা হওয়াই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ভারতের সামাজিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রগতি এখনো বাংলাদেশের তুলনায় শোচনীয় পর্যায়ে। দেশটির কোনো কোনো রাজ্যে নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের হাল বড় করুণ। কোনো কোনোটি অবিশ্বাস্যও। দু’বেলা অন্ন জোটে না এসব রাজ্যের কোনো কোনো সম্প্রদায়ের। বস্ত্রসংকটে আধা ন্যাংটা থাকতে হয়। কৃষক-শ্রমিকদের আত্মাহুতি দিতে হয় অভাব-অনটনের তোড়ে। কর্মসংস্থানের হালদশাও হৃদয়বিদারক। সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা গেছে, নিয়োগের সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা যেখানে পঞ্চম শ্রেণি পাস, সেখানে চাকরি নিতে পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও আবেদন করেছেন। তাদের সংখ্যা কম নয়, ৩ হাজার ৭০০ জন! ঘটনাটি ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের।

সেখানে পুলিশের টেলিকম শাখায় বেশ কয়েকজন পিয়ন নিয়োগ দেওয়া হবে। ৬২ পদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে ৯৩ হাজার ৫০০। শত কোটি মানুষের দেশে আবেদনকারীর সংখ্যা বিস্ময় না জাগালেও বিপুল সংখ্যক উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর আবেদনের ঘটনা বিস্ময়করই। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, শুধু তা-ই নয়, ৫০ হাজারের বেশি স্নাতক, ২৮ হাজার স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীও পিয়ন পদে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। বিপুলসংখ্যক অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর আবেদন পাওয়ায় পরীক্ষাপদ্ধতি বদলানোর কথা ভাবছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/আরআইপি