পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই আলোকে দুই যুগ পর নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত করতে বুধবার (১২ সেপ্টেম্বর) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। অভিন্ন নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিসসহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে ন্যূনতম ১০ বছরসহ মোট ২২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এমফিল প্রার্থীর ক্ষেত্রে সাত বছরসহ মোট ১৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় থাকতে হবে। পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্তদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ন্যূনতম ১২ বছর সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে একজন শিক্ষককে কমপক্ষে সাত বছর ক্লাসরুম শিক্ষকতাসহ ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। থিসিসসহ এমফিল প্রার্থীর ক্ষেত্রে ন্যূনতম ছয় বছরসহ নয় বছর সক্রিয় শিক্ষকতায় থাকতে হবে। পিএইডি ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম চার বছরসহ মোট সাত বছর শিক্ষকতা করতে হবে। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে একজন শিক্ষককে ন্যূনতম তিন বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। থিসিসসহ এমফিল ডিগ্রিধারীদের জন্য দুই বছর এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে এক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে স্বীকৃত কোনো জার্নালে অন্তত চারটি প্রকাশনা থাকতে হবে। এছাড়া বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, কলা, মানবিক, বিজনেস স্টাডিজ, চারুকলা ও আইন অনুষদভুক্ত বিষয়গুলোর জন্য প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী থেকে সহযোগী এবং সহযোগী থেকে অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য একটি অভিন্ন শর্তাবলী যোগ করা হয়েছে নীতিমালায়। একইভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়, মেডিসিন ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা শর্ত যুক্ত হয়েছে। গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-২-তে উন্নীত হতে হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে অধ্যাপক পদে অন্তত চার বছর চাকরি এবং স্বীকৃত কোনো জার্নালে বিষয়ভিত্তিক দুটি নতুন আর্টিকেল প্রকাশের শর্ত দেয়া হয়েছে। একইভাবে দ্বিতীয় গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের মোট চাকরিকাল অন্তত ২০ বছর এবং দ্বিতীয় গ্রেডের সর্বশেষ সীমায় পৌঁছানোর দুই বছর পর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রথম গ্রেড দেয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে। তবে এ সংখ্যা মোট অধ্যাপকের ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ১৫ থেকে ১৬ বছর। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১১ বছরেই অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ থাকে। কোথাও প্রভাষক পদে যোগ দিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রথম শ্রেণি বাধ্যতামূলক। আবার কোথাও যেকোনো একটিতে প্রথম শ্রেণি থাকলেই হয়। অভিন্ন নীতিমালা হলে এমন সুযোগ বন্ধ হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, অনেক দিনের সর্বোচ্চ চেষ্টায় অভিন্ন নীতিমালাটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। শিক্ষার মান বজায় রাখতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একই মানে উন্নীতকরণের চেষ্টায় আছি আমরা। এটা হলে চূড়ান্তভাবে শিক্ষার মান উন্নত হবে। শিক্ষকদের মধ্যে পদোন্নতি বৈষম্যও দূর হবে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতারা জানান, ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেলে বৈষম্যের প্রতিবাদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে তারা নিয়োগ ও পদোন্নতির বৈষম্য তুলে ধরেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে একটি মানসম্মত অভিন্ন নীতিমালা করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়।
Advertisement
মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে এ দায়িত্ব দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মঞ্জুরি কমিশন এ নীতিমালা চূড়ান্ত করতে বুধবার ইউজিসির অডিটোরিয়ামে একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ সংশ্লিষ্টরা সেখানে উপস্থিত থাকবেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এর উদ্বোধন করবেন।
ভিসিসহ সংশ্লিষ্টদের দেয়া সুপারিশ মঞ্জুরি কমিশনের পূর্ণাঙ্গা কমিটিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের পর নীতিমালাটি চূড়ান্ত হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নীতিমালাটি হলে শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য, রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য, পদোন্নতি জটিলতা, লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব কমাসহ শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সমন্বিত নীতিমালা না থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানও সমান নয় এবং ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বৈষম্যও দেখা দেয়। এ বৈষম্য দূর করতে ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে নীতিমালা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠায়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক সমিতিসহ রাজনৈতিক চাপের কারণে নীতিমালাটি আলোর মুখ দেখেনি। এর আগে ১৯৯৩ সালে প্রথম এ উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০২ ও ২০০৪ সালে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত হয়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আরও একবার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। ইউজিসি সূত্র জানায়, নীতিমালা তৈরি করতে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ আলী মোল্লাকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন- ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. শাহ নওয়াজ আলি, প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম, প্রফেসর ড. মো. আখতার হোসেন এবং ইউজিসি সচিব ড. মোহাম্মদ খালেদ। কমিটির সদস্য সচিব করা হয় ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের পরিচালক খন্দকার হামিদুর রহমানকে।
কমিটির সদস্যরা দীর্ঘদিন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতির নীতিমালা, কমিশনের বিদ্যমান নীতিমালা পর্যালোচনা করেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেশন ও বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বসে খসড়া নীতিমালাটি তৈরি করেন। এ ব্যাপারে কমিটির সদস্য খন্দকার হামিদুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূর করার চেষ্টা চলছে। সবার মতামত নিয়ে খসড়া নীতিমালা তৈরি হয়েছে। আশা করি সবাই এটি গ্রহণ করবেন। ভিসিরা কর্মশালায় তা চূড়ান্ত করবেন।
Advertisement
এমএইচএম/এএইচ/এমএআর/বিএ