একটি বিষয়কে উদাহরণ ধরে সংবাদ লেখার কৌশলটি সারা পৃথিবীর রিপোর্টারদের কাছে খুব প্রিয়। এই পদ্ধতিতে রিপোর্টার সরেজমিন কোন এলাকা ঘুরে দেখেন। কোন একটি সমস্যা অথবা সম্ভাবনা চিহ্নিত করেন। তার পর সেই সম্ভাবনা বা সমস্যার প্রভাব পড়েছে এমন একটি উদাহরণ ধরে প্রতিবেদনটি লেখেন।
Advertisement
গত সপ্তাহে কুমিল্লার হাসপাতালে এক বাবা ও মায়ের সন্তান রেখে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটির ওপর নজর রেখে আমিও একই সূত্রে বলতে চাই, “এই হচ্ছে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা”। এখানে টাকার ভয়ে অসহায় মানুষ সদ্যজাত সন্তান রেখে পালাতে বাধ্য হন।
গত সপ্তাহে প্রতিটি গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত ছিল নবজাতক রেখে বাবা মায়ের পালানোর খবরটি। প্রথম পড়ে আমিইতো নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলাম, এও কী কখনো হয়? মা বাবা মানে তো শুধু জন্মদাতা, জন্মদাত্রী নন। মা-বাবাতো প্রত্যকে ব্যক্তি জীবনের ভরকেন্দ্র, বিপদের শেষ আশ্রয়। সেই দুই চরিত্র এক সঙ্গে পালিয়ে গেল?
একটু করে তথ্য পাওয়া শুরু হলো ঘটনার পর দিন। এত দিনে গণমাধ্যমগুলো মোটামুটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। এখন সবার কাছে পরিষ্কার, কোন বেড়াজালে আটকালে মা-বাবার মত দৃঢ় চরিত্র পালিয়ে যায়। এরই মধ্যে ওই মাকে খুঁজে আনা হযেছে। সন্তানকে দেয়া হয়েছে তাঁর কোলে। তবু তিনি হাসেন নি। আর লজ্জায় এখনো আলোয় আসেননি বাবা নামের সেই বটবৃক্ষ ।
Advertisement
কারণ আর কিছু নয়, মা রোকেয়াই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি কুমিল্লার মা ও শিশু স্পেশালাইজট হাসপাতালে তৃতীয় বারের মত সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন অস্ত্রোপচার ছাড়াই। ছয় দিনে তাঁর বিল এসেছিল আড়াই লাখ টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানিয়েছিল এখন টাকা না দিলে, প্রতিদিন বিল বাড়বে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা । কীভাবে এই টাকার জোগাড় হবে, বুঝতে না পেরে শেষমেষ পালিয়ে গিয়েছিলেন বাবা মা।
হাসপাতালে স্ত্রীকে আনার আগে, দিনমজুর শাহ আলম খুব কষ্ট করে হাজার দশেক টাকা জোগাড় করেছিলেন। কারণ সরকারি হাসপাতালে পর পর দু’টি বাচ্চা মারা যাওয়ার পর আর সেখানে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাননি। কিন্তু এত টাকা খরচের বিষয়টি তাদের সরল ভাবনার বাইরে ছিল।
আসলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এরকমই ঝুঁকিপূর্ণ। যে রোগী যে যেরকম অর্থনৈতিক ক্ষমতার মানুষ তাঁর ঝুঁকিটা সেরকম। এখন নিশ্চয়ই অনেকে প্রশ্ন করবেন, কথা হলো একটা ঘটনার, সিদ্ধান্তে আসার বাকি গল্পগুলো কই? সেই বন্ধুদের কাছে আমার পাল্টা প্রশ্ন, দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হননি এমন মানুষ কী খুঁজে পাবেন? প্রত্যেক রোগীই একেকটা গল্প।
সবারই জানা তবু আলোচনার সুবিধার জন্যে আমাদের চিকিৎসা অবকাঠামো সবাইকে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই। সাদা চোখে আমাদের চিকিৎসা দুই ধরনের। একটি সরকারি। অন্যটি বেরকারি। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা ঘিরে রেখেছে দালাল ও চোর শ্রেণির একটি চক্র। ওই চক্রের বাইরে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে ঢোকাও সম্ভব নয়।
Advertisement
এছাড়া সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার, ওষুধ ও শয্যার মত জরুরি জিনিস পত্রের সংকট দীর্ঘ দিনের। যেখানকার তিক্ত অভিজ্ঞতায়, তিন নম্বর সন্তানকে বাঁচানোর আকুতি নিয়ে শাহ আলম-রোকেয়া বেসরকারি ব্যবস্থার কাছে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আসি বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে। এটাও শুরু থেকেই দালালদের দখলে। তবে সেই দালালির ধরন খানিকটা ভিন্ন। এখানে রোগী এনে হাসপাতালের কাছ থেকে কমিশন নেন প্যান্ট-জামা পরা ভদ্রলোক। ভুলিয়ে ভালিয়ে রোগী হাসপাতাল পর্যন্ত আনতে পারলেই হয়। বাকি দায়িত্ব নিয়ে নেন কর্তৃপক্ষ।
আমাদের বেসরকারি চিকিৎসায় “বিত্তবানদের চিকিৎসা” বলে আরেকটা ভাগ তৈরি হয়েছে গত বছর দশেক ধরে। এ ব্যবস্থায় চিকিৎসা নেয়া সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এখানে রোগী যত মুমূর্ষুই হোক পরিবারের টাকার ক্ষমতা নিশ্চিত না হয়ে কাউকে ভর্তি নেয়া হয় না। সেখানে সঙ্গে সঙ্গে টাকা না দিতে পারলে মৃত্যু পথযাত্রীকেও দেখিয়ে দেয়া হয় সরকারি হাসপাতালের পথ ।
আসলে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষ শত ভাগ নিরাপদ নন। কারণ এখানে মানুষ আর মুখ্য নেয়। মুখ্য চিকিৎসার নামের ব্যবসা। এখানে সবাই একেকজন শাহ আলম অথবা রোকেয়া। এরই মধ্যে শাহ আলম-রোকেয়া গ্রাম থেকে ফিরে এসেছেন হাসপাতালে। গ্রামের মানুষ ও স্বজনদের সহায়তা নিয়ে টাকা শোধ করেছেন।
অনেকেই ভাবছেন, এই যে সহায়তা তারা নিলেন, এটাতো আগেই করতে পারতেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই যে সহায়তা পেতেও রোগীকে বিশেষ বিপদে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। চাইলেই সবাই টাকা দেবে না। বিষয়টা এখন অনেকটা প্রথার মত হয়ে গেছে।
প্রথাটি অনেকটা এরকম, কোন মানুষ রোগে আক্রান্ত হবেন, শুরুতে তিনি চিকিৎসা ব্যায় মেটাবেন নিজের সঞ্চয় থেকে। তার পর ঘরের সম্পদ বিক্রি করবেন। এক পর্যায়ে ঋণ নেবেন। ঋণের পর্ব শেষ হলেই দয়া চাইবেন স্বজনদের কাছে। এই পর্বে স্বজনরা ফেরাবেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কারো কারো ক্ষেত্রে এখানে এসেও রোগ মুক্তি হয় না। তারা এক সময় হতাশ হয়ে চিকিৎসা নেয়া বন্ধ করে দেন।
এই যে নিরুপায় আত্মসমর্পণ, এও কী এক ধরনের পলায়ন নয়? মোদ্দা কথা এখানে পালাতেই হয়। কেউ শাহ আলমের মত এক সপ্তাহে পালান, কেউ এক বছরে পালান, আবার কেউ কেউ পাঁচ বছরে।
পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আমি বার বার গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এর কারণ আর কিছু নয়, বলতে চাইছি এই যে অব্যবস্থাপনার ছবি এর সবই প্রকাশ্য। তার পরেও এভাবেই চলে দিন। কেউ কখনো প্রশ্ন করে না যে, চিকিৎসার বিষয়টার সঙ্গে এখনো সেবা শব্দটি কেন যুক্ত? আর রাখাই যদি হলো, তাহলে এর দাম কেন নাগালের বাইরে? এই দামের সঙ্গে কী দেশের মানুষের আয়ের সঙ্গতি আছে? কে ঠিক করলো সেবার এই দাম?
যাদের নিয়মিত ঢাকার বাইরে যাওয়ার অভ্যেস আছে তারা দেখবেন, প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা শহরে দু’টি বিষয় খুব নেতিবাচক ভাবে চোখে পড়ে। প্রথমত বেসরকারি ক্লিনিক দ্বিতীয়ত তিন চাকার যান। ক্লিনিকের সংখ্যা এত বেশি যে, দেখলে মনে হয় এর চেয়ে সহজ আয়ের পদ্ধতি, বুঝি আর নেই। আর তিন চাকার বাহনের কারণে তো হাঁটাই দায়।
ক’দিন আগে শিক্ষার্থীদের উত্তাল আন্দোলনের জেরে তিন চাকার যান্ত্রিক বাহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও তো বহু খবর প্রচার হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। মানুষ নানা ভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর বিরক্তি প্রকাশ করছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
লেখক : বার্তা সম্পাদক , একাত্তর টেলিভিশন।palash_ahasan2003@yahoo.com
এইচআর/পিআর