ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম। বিকেলে আবার বের হতে হবে মারসিয়ার সঙ্গে। উনি বাইরে কিছু বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। মূলত এটি নিউ ইয়ার পার্টি। ওইদিন যেহেতু দেখা হয়নি, তাই পরবর্তীতে সাক্ষাৎ। আমাকে ডিনারে নিয়ে গেলেন। তিন ভদ্রমহিলা আর দুই ভদ্রলোক। তার মধ্যে একজন এখানকার গির্জার ফাদার। একজন অসাধারণ সহাস্যমুখ ব্যক্তি- ফাদার রামেন। নিজেও হাসেন, অন্যদেরও হাসাতে খুব পছন্দ করেন!
Advertisement
যখন মারসিয়া পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন খুব সম্মান করে বললেন, ‘ইনি সবার প্রিয় ফাদার রামেন, যিনি আমাদের কাছে দেবদূতের মত!’ ফাদার বললেন, ‘হ্যাঁ, দেবদূত বটে। তবে যার মাথায় দুটো শিং রয়েছে!’ তিন ভদ্রমহিলার মধ্যে একজনের বয়স ৮৫! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘তোমার বয়স কত?’ বললাম, ‘আটাশ’। উনি বললেন, ‘তোমাকে আমার আঠারো বছরের মনে হচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমার জীবনের মূল্যবান দশটি বছর ফেরত দেওয়ার জন্য!’
আমার দেশের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই মোটামুটিরকম জানতে চাওয়া হলো। আমি এক এক করে ভাষা থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ভাষা, কিভাবে বাংলা ভাষা এলো, এর পেছনের ইতিহাস, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন- সবকিছুই যোগ করলাম। আমাদের পোশাক কেমন, কেন এমন? আচার-আচরণে কখনো বড়দের নাম ধরে ডাকা যায় না, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হয়। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও বললাম। আবহাওয়া কেমন জানতে চাইলেন ফাদার। জানালাম, ‘আপনাদের এখানকার গ্রীষ্মকাল ওখানে শীতকাল। আর গরমকালে তাপমাত্রা বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মাঝে মাঝে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। হিটস্ট্রোকে মানুষের মৃত্যুও হয়।
এরপর ফাদার আমার সঙ্গে গল্প করা শুরু করলেন। অন্যরাও নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। প্রসঙ্গক্রমে পশু-পাখির কথা চলে এলো। উনি বললেন, ‘একটা সময় ছিল, যখন কাজ করতেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালনের সময় একটি জায়গা ছিল, যেটার ঠিক পাশেই ঘন জঙ্গল। রাতে ওনাকে মাঝে মাঝে ওদিকে যেতে হতো, তখন নেকড়ে বাঘের ডাক শুনতে পেতেন। দূর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসতো সেই ডাক। মজার বিষয় হচ্ছে, মাঝে মাঝে যখন উনি কোন ডাক শুনতে পেতেন না; তখন নিজেই অবিকল হাক দিতেন। আর একবার দিতেই সবদিক থেকেই ‘কুউ-উ-উ-উ’ শুরু হয়ে যেত! ওরা নিঃসন্দেহে ভেবে নিত এটা ওদেরই কোন সঙ্গী!
Advertisement
> আরও পড়ুন- হিমাচলে তুষার ঝড়ের কবলে- শেষ পর্ব
ফাদার আরো বললেন, ওনার এক বন্ধুর গো-শালা ছিল। ওখানকার গরু-গাভির নাম ধরে ডাকলেই ওগুলো সাড়া দিত! আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিভাবে?’ উনি বললেন, ‘হয়তো ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে, ওরা শব্দ না বুঝলেও হাক ডাকার বিশেষ ধরনটা বোঝে! আর প্রতিনিয়ত ওই একই ডাক শুনতে শুনতে ওরা অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং সাড়া দেয়।
এরপর প্রসঙ্গক্রমে রোহিঙ্গা ইস্যু এলো। তারা সবাই বেশ চিন্তিত। আফসোস করতে লাগলো। আমি বললাম, ‘আমাদের সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। আরও বেশি দেশ-বিদেশের সাহায্য পেলে সুবিধা হবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। খাবার অনেক আগেই চলে এসেছিল। চা, কফি, মিষ্টি ডোনাট- সেটাতে আবার ক্রিম লাগিয়ে খাওয়া যায়। শুধু রং চা-টা দিয়ে যাবে কাপে করে। বাকি দুধ-ক্রিম যা-ই ব্যবহার করতে হবে, এসবের জন্য ছোট ছোট জেলির মত এক ধরনের প্লাস্টিকের কৌটা আছে। ওগুলো টেবিলেই রাখা থাকে। যার যতটা ইচ্ছে ব্যবহার করা যাবে। দুই ভদ্রমহিলা পিৎজা অর্ডার দিয়েছিলেন, ওগুলোর সাথে প্লেটে ফ্রাইড মাংসও দেখতে পেলাম।
মারসিয়া আর আমার মেন্যু একই। ফাদার শুধু চা-ই খেলেন। আর ভদ্রলোক ফিস ফ্রাই সাথে লেটুস। তারাও যার যার দেশের কথা শেয়ার করলেন। কানাডার কোন প্রদেশে কী কী ধরনের সুবিধা আছে বা নেই। তাদের মতে, স্বাস্থ্যসেবায় প্রদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বৃটিশ কলম্বিয়া। আর নোভা স্কসিয়ার সিডনি পিছিয়ে থাকা প্রদেশগুলোর মধ্যে একটি। এই ছোট্ট শহরের নানা অসুবিধার মধ্যে অন্যতম সমস্যা বেকারত্ব।
Advertisement
তাদের ভাষ্য ছিল- আগে এই শহরই ছিল এ প্রদেশের মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধশালী শহর। বিংশ শতাব্দিতে যখন সিডনিতে উত্তর আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ স্টিল কারখানাগুলোর একটি (ডেসকো) ছিল, তখন সেখানে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ডেসকোতে শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকে। কানাডিয়ান সরকার নোভা স্কসিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ কর্মসংস্থান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার জন্য এটিকে সরকারিকরণ করে। তখন এর নাম হয় ‘সিডকো’ (সিডনি স্টিল কর্পোরেশন)। কিন্তুু ১৯৭০ সালের পর থেকে প্লান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে এবং কর্মসংস্থানের জন্য শ্রমিকরা অন্যখানে স্থানান্তরিত হয়। অবশেষে ২০০১ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০০ সালে যে ইস্পাত কারখানা শুধু কানাডাতেই নয়, পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ কারখানা ছিল। এক শতাব্দির ব্যবধানে তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেল। এর জন্য আন্দোলনও হয়েছিল।
> আরও পড়ুন- টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ- শেষ পর্ব
প্রায় তিন ঘণ্টার মত ছিলাম ওই রেস্তোরাঁতে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম। আসার পথে স্টেপলস্ থেকে একটি সিম নিলাম, যেটি সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না মারসিয়ার। স্টেপলস্ হচ্ছে এখানকার সব ধরনের স্টেশনারি, ল্যাপটপ- এসব জিনিসপত্র কেনার সুপার শপ।
বাসায় ফিরে রাতে ‘পারস্য প্রতিভা’ নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এর আগের রাতেও পড়েছিলাম। কারণ আমাকে পাঠচক্রের ফেসবুক পেজে লিখতে হবে। দেশ ছেড়ে আসার পর এটাই হবে পাঠচক্রের পেজের প্রথম লেখা! এর পরে ক্লাস শুরু হয়ে গেলে আরও লিখতে পারবো কিনা সন্দেহ? পরবর্তীতে শঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হলো! কিছুটা উত্তেজনা কাজ করলেও কালই ইউনিভার্সিটি যেতে হবে, এটা মনে করে ভালো লাগছিল না। আমার স্টাডি পারমিটে সমস্যা আছে, যা আমাকে ক্যাম্পাসের বাইরে (অফ-ক্যাম্পাস) জব করার অনুমতি দেয় না। পরে জানতে পেরেছিলাম, এবারের ব্যাচে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি এবং এ সমস্যা শুধু আমারই!
চলবে...
এসইউ/এএ/এমএস