বিশেষ প্রতিবেদন

প্রয়োজন নিজ অভ্যাসের পরিবর্তন

চলছে ট্রাফিক মাস। কিছুদিন আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারাদেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন হয়েছে। এ অবস্থায় যত্রতত্র রাস্তা পারাপার বন্ধে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে। সেটা কতটুকু পালন করছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা- তা দেখতে গতকাল রোববার রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে বনানী পর্যন্ত বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান করে সরেজমিন সার্বিক চিত্র তুলে আনার প্রয়াস চালানো হয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে।

Advertisement

দুপুর ১২টায় আব্দুল্লাহপুর মোড়ে অবস্থান করে দেখা যায়, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের জন্য মানুষের লম্বা লাইন। এ সময় দুই যুবক তীব্র যানজটের মধ্যে গাড়ির ফাঁক গলিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের দেখাদেখি কিছু মহিলা ও স্কুল শিক্ষার্থী একই পথ ধরেন। কিন্তু মাঝপথে তাদের আটকে দেন দায়িত্বরত স্কাউটের সদস্যরা।

শুরু হয় বাগবিতণ্ডা, তারা মাঝ রাস্তা দিয়েই যাবেন। অবশেষে এগিয়ে এলেন দায়িত্বপাপ্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট। কড়া ভাষায় তিনি জানিয়ে দিলেন, ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পার হওয়া যাবে না। ফিরে যেতেই হবে। বাধ্য হয়ে ফিরে আসলেন সবাই। এ সময় একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরাও চাই এমনটা হোক।’ সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করছেন। দু-একজন অবশ্য ঝুঁকি নিতে চাইছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত স্কাউট ও পুলিশ সদস্যরা তাদের বোঝাচ্ছেন। ফলে তারাও নিয়ম মেনে পার হচ্ছেন রাস্তা।

কথা হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত স্কাউট সদস্য মুনতাসিরের সঙ্গে। তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সবাই তাদের সাপোর্ট করেছে। কিন্তু এখন অনেকেই আইন মানতে চাচ্ছেন না। এটা কেমন কথা! যারা আইন মানতে চাইছেন না, তাদের মাঝপথ থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। যদি তাদের বোধশক্তি কিছুটা বাড়ে।

Advertisement

উত্তরা হাউস বিল্ডিংয়ে অবস্থিত ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের জন্য লম্বা লাইন দেখা যায়। এক স্কাউট সদস্য দুটি লাইন মেইনটেইন করছেন। এক লাইনে লোকজন নামছেন, অন্য লাইনে উঠছেন। এই ওভার ব্রিজের ওঠা-নামার সিঁড়ি এত সরু যে দুই লাইনের বেশি করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ফুটওভার ব্রিজ ছাড়িয়ে ফুটপাতে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন।

রাস্তার মাঝামঝি স্কাউট ও পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন লাঠি নিয়ে। কেউ নিচ দিয়ে রাস্ত পার হতে চাইলে বাঁশি বাজাচ্ছেন। লাঠি দিয়ে ইশারা করছেন না আসার জন্য। তবুও ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ রাস্তা পার হচ্ছেন। অনেকে উঁচু ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনীহা দেখাচ্ছেন।

আব্দুল্লাহপুর থেকে আসার পথে হাউস বিল্ডিংয়ে যে সিগন্যাল পড়ে সেখান দিয়ে অহরহ মানুষ পার হচ্ছেন। তাদের একজন আলাউদ্দীন। বলেন, এখান দিয়ে পার না হয়ে উপায় নেই। যাব ১০ নম্বর সেক্টরে। ওই দিক দিয়ে পার হতে গেলে অনেক পথ হাঁটতে হয়। এছাড়া ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে হলে দুটি সড়ক ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হবে। এদিকে আরেকটি ফুটওভার ব্রিজের দরকার ছিল।

অনেকে মনে করেন, চলন্ত সিঁড়ি থাকলে হয়তো ফুটওভার ব্রিজে উঠতে কেউ অনীহা দেখাবেন না। বাস্তবতা হলো, সচেতনতা না বাড়লে আর অভ্যাস না গড়লে কিছুতেই কাজ হবে না। এয়ারপোর্ট আর বনানীর ফুটওভার ব্রিজের কাছে এসে এমন উপলব্ধি হলো।

Advertisement

বেলা ৩টার দিকে এয়ারপোর্টে অবস্থিত ফুটওভার ব্রিজে অবস্থান করে দেখা যায়, সুদৃশ্য এই ওভার ব্রিজ ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি। এখানে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। অনেকেই চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহার করছেন। আবার অনেকে তা ব্যবহার না করে অন্য প্রান্ত দিয়ে হেঁটেই ব্রিজে উঠছেন।

চলন্ত সিঁড়ির সুবিধা দেয়ার পরও কিছু লোক এয়ারপোর্টের গোলচত্বর বরাবর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যস্ত এ সড়ক পার হয়ে হাজী ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছেন। বাধা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না।

এয়ারপোর্টের ফুটওভার ব্রিজের অপর প্রান্তের চলন্ত সিঁড়িটি নষ্ট। কাছে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কারিগর সেটি ঠিক করার কাজে ব্যস্ত। কথা বলে জানা যায়, বেশ কয়েকদিন ধরে অচল পড়ে ছিল চলন্ত সিঁড়িটি। ট্রাফিক মাস চলছে বলে এটি ঠিক করা হচ্ছে। আজ-কালের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে- জানান তারা।

কাউলায় এসে দেখা যায়, এখানকার ফুটওভার ব্রিজটি সবাই ব্যবহার করছেন। একই অবস্থা দেখা যায় খিলক্ষেতেও। ওই দুই পয়েন্টে কাউকে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায়নি। তবে খিলক্ষেতের পুরো উল্টো চিত্র বিশ্বরোডে। এখানে ৯০ শতাংশ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এ সড়কের পাশাপাশি এখানে রয়েছে একটি লেভেল ক্রসিং। এ ক্রসিংয়ে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটায় বাধ্য হয়ে দেয়া হয়েছে সুউচ্চ দেয়াল। রাখা হয়েছে একটি গেটও। ট্রেন আসলে সেই গেট বন্ধ করে দেয়া হয়।

সুদৃশ্য ফুটওভার ব্রিজ থাকার পরও কেন সেটি ব্যবহার করছেন না- এমন প্রশ্ন করা হলে রাস্তা পারাপারে জন্য অপেক্ষমাণ সুমনা আক্তার জানান, যাব যমুনা ফিউচার পার্কে। এদিক দিয়ে রাস্তা পার হলে সোজা রেল ক্রসিংয়ের গেট। ফুটওভার ব্রিজটি ব্যাকওয়ার্ড প্লেসে করা হয়েছে। বিশ্বরোডে নামলে আবারও পেছনে যেতে হয়। সেখান থেকে লেভেল ক্রসিংয়ের গেটটিও বেশ দূরে। ফলে সবাই ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন।

এয়ারপোর্টের মতো বনানীতেও রয়েছে চলন্ত ফুটওভার ব্রিজ। এটির ব্যবহারও বেশ। তবে নিচ দিয়ে পারাপারের আগ্রহও কম নয়। বনানী থেকে যারাই আসছেন তাদের প্রায় সবাই নিচ দিয়ে পার হচ্ছেন। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও তেমন কাজে আসছে না।

ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার নিয়ে ট্রাফিক উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) প্রবীর কুমার রায় জাগো নিউজকে বলেন, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে আমরা নানা ধরনের সচেতনতামূলক কাজ করছি। রোভার স্কাউট সদস্যরা আমাদের সাহায্য করছেন। এরপরও অনেকে ওভার ব্রিজ ব্যবহার করছেন না। সত্যি বলতে, এটা আমাদের অনেক দিনের অভ্যাস।

‘অভ্যাস না থাকায় কেউ ৫-১০ মিনিট অতিরিক্ত হেঁটে ওভার ব্রিজে উঠতে চান না। তবে এই অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। এটি পরিবর্তনের জন্য আইন আছে, জরিমানার ব্যবস্থাও আছে। আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। তাতে কাজ না হলে আইন প্রয়োগ করা হবে।’

‘নিজ থেকে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় না নিলে স্কাউট বা পুলিশ দিয়ে আইন প্রয়োগ করে কোনো লাভ হবে না’- যোগ করেন প্রবীর কুমার রায়।

এমএ/এমএআর/আরআইপি