‘কষ্টের জমানো টাকায় ঢাকা শহরে একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য আবাসন নির্মাতা (ডেভেলপার) ডোম-ইনো বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করলেন। চুক্তি অনুযায়ী কিস্তির সব টাকাও পরিশোধ করেছেন। কথা ছিল, ৩৮ মাসের মধ্যে বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এবং এরপরই ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হবে। ৩৮ মাস পেরিয়ে আরো প্রায় দুই বছর যাচ্ছে। কিন্তু ডোম-ইনো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে পারছে না ক্রেতাদের। একেক সময় একেক কথা বলে দিনের পর দিন শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে ক্রেতাদের।’ নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এভাবেই নিজের কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন ডোম-ইনো থেকে ফ্ল্যাট কেনা এক ক্রেতা। তিনি রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরিপাড়ার বি ব্লকে ২০১ বাড়িতে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাড়িটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডোম-ইনো বিল্ডার্স লিমিটেড। এভাবে ফ্ল্যাট ব্যবসার নামে গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ ওঠছে ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে। যদিও এক সময় কোম্পানিটির সুনাম ছিলো। কিন্তু সেখান থেকে সরে গ্রাহকের সঙ্গে যেন প্রতারণা করছে কোম্পানিটি। সূত্র বলছে, সম্প্রতি রাজধানীতে ফ্ল্যাট বিক্রির লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েও বুঝিয়ে দিচ্ছে না সেই ফ্ল্যাট।ডোম-ইনোর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন লোকেশনে শতাধিক প্রকল্প আছে কোম্পানিটির। তবে সে সব ফ্ল্যাট প্রকল্পের বেশির ভাগেরই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ফ্ল্যাট ক্রেতা বা জমির মালিককে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানি।সূত্র মতে, রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকায় ডোম-ইনোর একটি প্রকল্প চলছে। কোম্পানিটি ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে ফ্ল্যাট নির্মাণ শেষ করে জমির মালিক ও ফ্ল্যাট ক্রেতাদের বুঝিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তুি এখন পর্যন্ত তা শেষ করতে পারেনি।একইভাবে, ধানমন্ডির নতুন ১১ নম্বর সড়কে রয়েছে কোম্পানিটির আরেকটি প্রকল্প। সেটি হস্তান্তর করার কথা ছিলো ২০১৩ সালের জুলাই মাসের ৩১ তারিখে। কিন্তু দু’বছর পেরিয়ে গেলেও বুঝিয়ে দিতে পারেনি ডোম-ইনো । খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ায় বি ব্লকের ২০১ বাড়িটি নির্মাণ শেষ করার কথা ছিলো ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট। কিন্তু সেটিও শেষ করতে পারেনি তারা। সূত্র বলছে, বাড়িটির অনেক কাজ এখনো বাকি আছে।নির্মাণাধীন ভবনটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অমিত শাহ জাগো নিউজকে বলেন, এখনো অনেক কাজ বাকি। কিন্তু গত ঈদের পর থেকে কোন কাজ শুরু হয়নি। জানি না, কোম্পানি কেন কাজ শুরু করছে না।বাড়িটি নির্মাণের দায়িত্বে থাকা রঞ্জিত মন্ডল জাগো নিউজকে টেলিফোনে বলেন, পুরোদমে কাজ করলেও মনে হয় না, আগামী এপ্রিল মাসের আগে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হবে খিলগাঁও এর এই প্রকল্পের ফ্ল্যাট ক্রেতাদের। কাজ শুরু হতে কত দিন লাগবে জানতে চাইলে বলেন, শিগগিরই শুরু করব।তিনি বলেন, এখনো টাইলস বসানো, গ্যাসের লাইন বসানো, দরজা-জানালার অনেক কাজ বাকি। তাছাড়া রং এর কোন কাজ তো ধরাই হয়নি। ধরে রাখতে পারেন, এক বছর লেগে যেতে পারে। এই প্রকল্পে ফ্ল্যাট কিনে এখন বেকায়দায় আছেন তিন প্রবাসী বাংলাদেশি। যাদের কষ্টের টাকায় দেশের রিজার্ভ বাড়ছে। যারা অর্থনীতির চাকাকে রেখেছেন সক্রিয়। যোগান দিচ্ছেন বৈদেশিক মুদ্রার।একইভাবে একজন ব্যবসায়িও ফ্ল্যাট কিনেছেন এই প্রকল্পে। রয়েছেন একজন ব্যাংকার, একজন বীমা খাতের পেশাজীবী ও একটি গ্রুপ অব কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নিজের স্থায়ী ঠিকানায় ওঠার জন্য তারা দীর্ঘ দুই বছর ধরে অপেক্ষা করছেন।একজন ক্রেতার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি বলেন, ডোম-ইনো নাম শুনে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু কোম্পানিটি এমন হয়রানি করবে বুঝতে পারিনি।খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার প্লটটির মালিক শামসুল হক নামে এক ব্যক্তির। তিনি এব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি। তবে এক বাক্যে বলেন, চুক্তি ছিলো দুই বছর আগে নির্মাণ শেষ করবে। কিন্তু দেখতেই তো পারছেন কি অবস্থা।অবশ্য রঞ্জিত মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, আমার খিলাগাঁও প্রকল্পের ফ্ল্যাট ক্রেতা ও জমির মালিক অনেক ভালো বলে তারা খুব বেশি চাপ দিচ্ছে না। তাই চুক্তির বাইরে দুই বছর বেশি সময় লাগলেও তারা খুব বেশি কিছু বলছেন না। ডোম-ইনোর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, চুক্তি মোতাবেক যেমন ফ্লাট বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কোম্পানিটি। আবার চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জমির মালিককে মাসিক ভিত্তিতে যে অর্থ পরিশোধ করার কথা সেটিও নিয়ে টালবাহানা করে ডোম-ইনো।ডোম-ইনোর ধানমন্ডির একটি প্রকল্পের একজন ক্রেতা বলেন, ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিলে খুব শিগগিরই রাজউকের কাছে অভিযোগ করবেন তিনি। তিনি আরো বলেন, শুনেছি গৃহায়ণ মন্ত্রি প্রতি মাসের শেষ বুধবার রাজউকে বসেন গ্রাহক হয়রানির কথা শুনতে। সুযোগ পেলে আমি তার কাছেও অভিযোগ করব। এছাড়া আবাসন খাতের ব্যবসায়িদের সংগঠন রিহ্যাবের কাছেও যাবার পরিকল্পনা আছে। অবশ্য জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহ সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, কোন কোম্পানির বিরুদ্ধে যদি কোন ক্রেতা সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ নিয়ে আসেন, তবে অবশ্যই আমরা তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিবো। এতে কোন ছাড় দেয়া হবে না। প্রয়োজনে ওই কোম্পানির সদস্যপদ বাতিল করা হবে।তবে ডোম-ইনো বিল্ডার্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানির বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালামকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তবে জাগো নিউজের কথা হয়, ডোম-ইনোর পরিচালক প্রকৌশলি জিনাতুল কবীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনেক ফ্ল্যাট চুক্তির শর্ত অনুযায়ি হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না এটি ঠিক। তবে এর কিছু ব্যর্থতা যেমন আমাদের আছে। একই সঙ্গে অনেক ক্রেতা ফ্লাটের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। সব মিলিয়ে একটি খারাপ সময় যাচ্ছে। ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সুনাম ব্যবহার করে সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ এখন ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেত টালবাহানা করছে। প্রবাসী ও মধ্যবিত্তের কষ্টার্জিত অর্থ হাত করে এখন ব্যবসা গোটানোর পাঁয়তারা করছে কোম্পানিটি। রাজধানীতে ডোম-ইনোর প্রায় শতাধিক প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে গুলশান, উত্তরা, ইস্কাটন, মিরপুর, খিলাগাও, ঝিগাতলা, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নাখালপাড়া, ইকবাল রোড, বনানী, শ্যামলি, বসুন্ধরা, রাজাবাজার, লালমাটিয়া, মগবাজার, আরামবাগ, বেইলি রোড, বাড়িধারা ও সবুজবাগ এলাকায় বেশ কিছু প্রকল্প চলছে।এসএ/এআরএস/পিআর
Advertisement