ইট-পাথরের যান্ত্রিক শহরে ছোট্ট একটা বাসা, এক চিলতে ছাদ, ছোট ঝুল বারান্দাটা- এইতো মধ্যবিত্তের স্বপ্নের জগত। এর বাইরে তারা কল্পনাই করতে পারে না। বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের সেই যান্ত্রিক কল্পনায় মায়াবী দ্যুতি ছড়াচ্ছে জাম্বুরি পার্কের নিয়ন আলোর নয়নমোহন খেলা।
Advertisement
বলছিলাম চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ জাম্বুরি পার্কের কথা। অপরিকল্পিত নগরের বুকে পরিকল্পিত সৌন্দর্যের প্রতীক ‘জাম্বুরি পার্ক’। সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে, কম্পাউন্ড রোড আর সন্ধ্যায় আলো-আঁধারের খেলা সহজেই মন কেড়েছে সবার। কর্মব্যস্ত এ নগরে হাঁফ ছেড়ে একটু নিঃশ্বাস ফেলতে জাম্বুরি পার্কে ছুটে আসছে হাজারও মানুষ। নাগরিক জীবন থেকে ফুরসত মিলতেই ছুটছে এক চিলতে প্রশান্তির খোঁজে।
অথচ এইতো ক’দিন আগেও আগ্রাবাদের ওই বিশাল জাম্বুরি মাঠটি ছিলে পরিত্যক্ত। অবৈধ দখলদাররা একপাশে সবজি ফলালেও অপরপাশে বসত মাদকের আসর। আঁধারঘেরা সেই জাম্বুরি মাঠে এখন সন্ধ্যার পর চলে আলো-আঁধারের খেলা। বদলে যাওয়া পরিবেশের সঙ্গে বদলে গেছে নামও। জাম্বুরি মাঠ এখন জাম্বুরি পার্ক। গতকাল শনিবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে এই পার্কের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানান, বন্দরনগরীর এই নতুন পার্কটি প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। এখানে প্রবেশে লাগবে না কোনো টাকা।
Advertisement
তবে উদ্বোধনের অনেক আগেই চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে নতুন এই বিনোদনক্ষেত্রকে ঘিরে। বিকেল গড়ালেই নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠছে জাম্বুরি পার্ক। বন্দরনগরীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হওয়া এ জায়গাটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছেও রয়েছে পছন্দের শীর্ষে। নির্মল আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে একান্তে কিছু সময় কাটানোর জন্য প্রতিদিনই কপোত-কপোতীরা জড়ো হচ্ছেন এখানে। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নানান বয়সের যুগলদের ঢল নামে জাম্বুরি পার্কে। সন্ধ্যার পর রঙ-বেরঙের আলোর খেলা আর পানির ফোয়ারার তালে তালে যেন রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যান ব্যস্ত নগরীর ক্লান্ত মানুষগুলো।
বিকেল শুরু হতে না হতেই দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেন জাম্বুরি পার্কে। দেখতে দেখতেই এলাকাটি যেন মিলনমেলায় পরিণত হয়। পড়ন্ত বিকেলে শিশু-কিশোরদের ঘোরাঘুরি, সন্ধ্যার একটু আগ থেকেই তরুণ-তরুণীদের হাঁটাহাঁটি-আড্ডা। কেউ কেউ সেলফি তুলছেন, তা আবার ফেসবুকে আপলোডও করছেন। বিশাল পার্কে আলো-আঁধারির সৌন্দর্য উপভোগ করতে স্ত্রী, সন্তান এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে অভিভাবকরা ও এসেছেন দলে দলে। শনিবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জাম্বুরি পার্কে চোখে পড়ে এমন দৃশ্য।
পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন চকবাজারের বাসিন্দা জাহেদুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই শহরে পতেঙ্গা বা ফয়েস লেক ছাড়া বেড়ানোর অন্য তেমন কোনো জায়গা নেই। কিছুদিন ধরে জাম্বুরি পার্কের কথা শুনছিলাম। সন্তানদেরও তেমন একটা সময় দিতে পারি না। তাই আজ তাদের নিয়ে জাম্বুরি পার্কে এলাম।’
নগরের ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মনসুরা কাজী ক্লাস শেষে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে এসেছেন জাম্বুরি পার্কে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘গত কিছুদিন ধরে ভার্সিটি শেষে বন্ধুদের নিয়ে এখানে আসি। হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি আড্ডা দেই কিছুক্ষণ। ভালো লাগে। আশপাশে আর সময় কাটানোর মতো ভালো জায়গা নেই। তাই জাম্বুরি পার্কেই আসি।’
Advertisement
কর্ণফুলী ইপিজেটে একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ও আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা খালেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশপাশের জেলাগুলোতেও বিনোদনের যেসব সুবিধা রয়েছে সে তুলনায় আমাদের চট্টগ্রামে বিনোদনের সুযোগ খুবই সীমিত। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগর ক্রমে রাজধানী ঢাকার মতো জনবহুল হয়ে উঠছে। এ যান্ত্রিক যুগে মানুষ একটু সময় পেলে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তাই জাম্বুরি পার্ক একটি অনন্য উদ্যোগ। তবে পার্ককে একেবারে উন্মুক্ত করে না দিয়ে নামমাত্র ফি নির্ধারণ করে দিলে অপরাধ জগতের বাসিন্দাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।’
আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার আলম পুরো জাম্বুরি মাঠকে পার্কে পরিণত করাকে ঠিক হয়নি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘নগরের সব বিনোদনপ্রেমীরা জাম্বুরি পার্কে ভিড় করছে, কিন্তু আমাদের এলাকার ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার কোনো জায়গা রইলো না। কর্তৃপক্ষ চাইলে পার্কের মধ্যেও একটি ছোট মাঠ রাখতে পারতো।’
রাজধানীর রমনা পার্কের আদলে নির্মিত জাম্বুরি পার্কে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে আর কম্পাউন্ড রোড মিলে রয়েছে আট হাজার ফুট জগিং ট্র্যাক। পার্কটির মাঝে ৫০ হাজার বর্গফুটের জলাধার রাখা হয়েছে। জলাধারের কিনারায় উন্মুক্ত বসার স্থান, ক্লোজ সার্কিট ক্যামরা এবং নারী-পুরুষের জন্য আলাদা শৌচাগার রয়েছে।
স্থাপত্য অধিদফতরের নকশায় মাঠজুড়ে সাড়ে পাঁচশ লাইটের পাশাপাশি নজরকাড়া দুটি বর্ণিল ফোয়ারা রয়েছে। বিশাল পার্কজুড়ে লাগানো হয়েছে সোনালু, শিউলি, নাগেশ্বর, টগর, হৈমন্তী, শিমুল, সাইকাস, রাঁধাচূড়া, কাঠচাঁপা, জারুল, বকুলসহ ১০ হাজার ফলদ ও বনজ গাছ। প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১৫ সালে। প্রায় সাড়ে আট একর জমির উপর পার্কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের শুরুতে।
আবু আজাদ/বিএ/পিআর