খেলাধুলা

গোল করতে না পারার ব্যর্থতাই ডোবালো বাংলাদেশকে

ফুটবলে দূর পাল্লার শটে গোল হয় অনেক। আন্তর্জাতিক ফুটবল, বিশ্বকাপ, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ, কোপা আমেরিকা কাপ, স্প্যানিশ লিগ, ইংলিশ লিগ, ইতালিয়ান লিগ, ফরাসী লিগ, জার্মান বুন্দেসলিগায় অহরহ দূরপাল্লার শটে গোল দেখা যায়। তবে তার বেশীর ভাগই লক্ষ্যভেদী প্রচন্ড গতির শটে। আর না হয় দূর থেকে নেয়া বাকানো ফ্রি-কিকে।

Advertisement

বাংলাদেশের ফুটবল তীর্থ এই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ফুটবলারদের দূর পাল্লার শটে করা কয়েকটি অবিস্মরণীয় ও দৃষ্টিননন্দন গোল রয়েছে। যার অন্যতম ও সেরা গোলটি দেশ বরেন্য স্ট্রাইকার শেখ আসলামের। ১৯৮৫ সালের সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে কামানের গোলার মত শটে গোল করেছিলেন আসলাম।

তার প্রচন্ড লক্ষ্যভেদী শট সে সময় ভারত তথা দক্ষিন এশিয়ার এক নম্বর গোলকীপার অতনু ভট্রাচার্জকে বোকা বানিয়ে জালে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল। এখন যাদের বয়স চার যুগ বা তার বেশী সেই সব ফুটবল অনুরাগীদের অনেকের মনেই সে গোলের স্মৃতিভাস্বর হয়ে আছে। এই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে চীনের আঞ্চলিক এক দলের বিপক্ষে মোহামেডানের প্রয়াত মনুর ৩৫ গজের বেশী দূর থেকে নেয়া গোলের কথাও এখনো অনেকের মুখে মুখে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও আজ সেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নেপালের বিমল ঘার্তি মাগারের গোলও দীর্ঘ দিন ঢাকার ফুটবল অনুরাগিদের মনে দাগ কেটে থাকবে। তবে সেটা ঐ নেপালী ফুটবলারের শ্যুটিং দক্ষতার কারণে নয়। ঐ গোলটি বাংলাদেশের প্রতিটি ফুটবল ভক্তের মনে থাকবে স্বপ্ন ভঙ্গের প্রতীক হয়ে। খেলার ৩৩ মিনিটে নেপালের বিমলের প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে নেয়া ফ্রি কিক বাংলাদেশ গোলকিপার সোহেলের হাত ফসকে জালে পৌঁছে গেল।

Advertisement

যে শটে জোরের ‘জ’টাও ছিলোনা। বল বাতাসে বাঁক খেয়েও ঢুকেনি। এমনকি প্লেসিংটাও ভাল ছিলনা। গোলকিপার সোহেলের দু’হাত ফসকে বল গোল লাইন অতিক্রম করলো।

এমন দুর্বল, কম জোরি ও গোলকিপার সোজা শটে দক্ষিন এশীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারনী আসর তো বহু দূরে, পাড়ার ফুটবলেও গোল হয় খুবই কম। পাড়ার কিশোর-তরুণরাও অমন কম জোরি সোজা শট অনায়াসে ধরে ফেলেন। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয় দলের গোলকিপার সোহেল সেই আলতো শটও ধরে রাখতে পারেননি। তার হাতের ফাঁক গলে আর কোটি বাঙ্গালীর মন ভেঙ্গে আশা চুরমার করে বল চলে গেছে গোলে।

যে শট গোলকিপারের অনায়াসে ধরার কথা, যে দুর্বল কিক থেকে গোল হবার সম্ভাবনা প্রায় শুন্যের কোঠায়, সেই শটেই গোল! খুব স্বাভাবিকভাবেই হতোদ্যম হয়ে পড়া। আগের দুই ম্যাচে ভুটান ও পাকিস্তানের বিপক্ষে উজ্জীবিত ও সাজানো ফুটবল খেলা বাংলাদেশ দলও অমন গোল খেয়ে কেমন যেন হতোদ্যম হয়ে পড়লো।

সে কারনেই গোলকিপার সোহেল হয়ে পড়লেন খলনায়ক। খেলার বাকি সময়টুকু সোহেলকে দর্শকদের দুয়ো ধ্বনি শুনেই কাটাতে হলো। কিন্তু আসলেই কি সোহেল একা দায়ী? তার হাত ফসকে বেড়িয়ে যাওয়া ঐ গোলটিই কি বাংলাদেশের পরাজয়ের একমাত্র কারণ?

Advertisement

কেউ কেউ অবশ্য তা বলছেন। কারো চোখে সোহেলের ভুলের চরম খেসারত দিয়ে ঘরের মাঠে সাফ ফুটবল থেকে বিদায় বাংলাদেশের। কিন্তু আসলে কি তাই? সত্যিই কি সোহেল একা দায়ী? হ্যাঁ বাংলাদেশ এক গোলে হারলে অবশ্যই তাকেই ‘ভিলেন’ হয়ে থাকতে হতো। কিন্তু ২-০ গোলে হারের পর শুধু কি সোহেলকেও দায়ী করা যায়?

এটা বলা যেতে পারে সোহেলের ভুলে খেলার প্রায় ধারার বিপক্ষে গোল খেয়ে বাংলাদেশ হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারপরেও আরও ৫৭ মিনিট খেলা হয়েছে। গোল শোধ এবং আরও এক গোল করে ম্যাচ জেতার পর্যাপ্ত সময় ছিল সামনে। ঐ গোলটিই শেষ মুহুর্তে খেলে বলা যেত যে, শোধরানোর সময় ছিলনা। তাই পরাজয়। কিন্তু তাতো হয়নি।

সোহেলের ভুলে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ বাকি ৫৭ মিনিটেও গোল শোধ করতে পারেনি। গোল শোধ করার জন্য যে তেড়েফুড়ে আক্রমণ করা দরকার ছিল, যেমন সাজানো-গোছানো আক্রমণ করলে নেপাল রক্ষণভাগ বালির বাধের মত ভেঙ্গে পড়তো- তা রচনা করা সম্ভব হয়নি। পাসিং মন্দ হয়নি। বলের নিয়ন্ত্রনও বেশীর ভাগ সময় বাংলাদেশের অনুকূলেই ছিল।

স্বাগতিকরা নিজেদের মাঝে দেয়া নেয়া করেও খেলেছেন। কিন্তু গতি কম ছিল। আর আক্রমণগুলোয় তীব্রতাও ছিল কম। বরং শেষ দিকে কাউন্টার অ্যাটাকে উল্টো নেপাল গোল সংখ্যা দ্বিগুণ করে ফেলে। দ্বিতীয়ার্ধে নেপালীদের দ্রুত গতির কাছে আরও একবার বাংলাদেশ রক্ষণভাগে ফাটল ধরে। গোলকিপারের দৃঢ়তায় সে যাত্রা রক্ষা হলেও নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিট আগে আর রক্ষা হয়নি। ৯০ মিনিটে নেপাল দ্বিতীয় গোল করে বসে।

প্রথম দুই খেলায় ভুটানের সাথে ২-০ আর দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানকে ১-০ গোলে হারানোর পরেও গোল ব্যবধানে পিছিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ডোবা। তিন ম্যাচে নেপাল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পয়েন্ট সমান ছয় হলেও গোল ব্যবধানে পিছিয়ে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন ভাঙে বাংলাদেশের। তিন ম্যাচে ৭ গোল করে আর দুই গোল হজম করা নেপাল হাতে ৫ গোল থাকায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। অন্য দিকে তিন ম্যাচে ৫ গোল দেয়া পাকিস্তান দুই গোল হজমের পরও তিন গোল হাতে রেখে গ্রুপে দ্বিতীয়। আর আগের দুই ম্যাচে তিন গোল দেয়ার পরেও তৃতীয় ম্যাচে ২-০ গোলে হেরে বসায় মাত্র এক গোল হাতে থাকে বাংলাদেশের।

শনিবার দিনের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তান ৩-০ গোলে ভুটানকে হারানোয় হঠাৎই সমীকরণ বদলে যায়। তাতে করে বাংলাদেশের সেমিতে খেলার জন্য অন্তত ড্র অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অবস্থা এমন দাড়ায় যে, গোল গড়ে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ আজ যে কোন ব্যবধানে হারলেই বিদায় নেবে।

আর সে কারনেই একটু বেশী রক্ষণাত্মক কৌশলে মাঠে নামে বাংলাদেশ। আর সেটাই কাল হয়। কাজেই সোহেলকে একা দায়ী করার কোনই যৌক্তিক কারণ নেই। এ ম্যাচ ড্র রাখতে পারলে বাংলাদেশ হতো গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। সোহেলের ভুলে হজম করা এক গোলে হারলে বলা যেত সোহেল খলনায়ক। কিন্তু দ্বিতীয় গোল হজমের পর আর তা বলার কোনই অবকাশ নেই। তার চেয়ে বড় কথা পাকিস্তান ও নেপালের চেয়ে কম গোল করাও বিদায়ের বড় কারণ।

তেড়েফুড়ে আক্রমন শানানোয় ব্যর্থতা এবং গোলের সুযোগ কাজে লাগানোর সামর্থ্যে ঘাটতিও ঘরের মাঠে সেরা চারে থাকতে না পারার বড় কারণ। তাই একা সোহেলকে বলির পাঠা বানানো যুক্তিহীন।

মাঠ বড় করে দুই উইং দিয়ে দ্রুতগতির আক্রমণ সম্ভব হয়নি। মাঝমাঠে সৃজন ও সৃষ্টশীলতায় ঘাটতি এবং নেপালি রক্ষণভাগে ফাটল ধরানোর মত বিপদজনক থ্রু ও নিপুণ সেন্টার করার সামর্থ্যেও ছিল কমতি। শুধু বলের নিয়ন্ত্রণটাই ছিল বেশি। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে এটাই শেষ কথা নয়।

নিজেদের মধ্যে বেশি সময় দেয়া-নেয়া করে খেলে লাভ নেই, যদি গোলের সত্যিকার সুযোগ তৈরি করা না যায়। সেখানেই পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। তার প্রামাণ্য দলিল নেপালের যেখানে তিন ম্যাচে সাত গোল, সমান খেলায় পাকিস্তানের পাঁচ আর বাংলাদেশের মাত্র তিন। তাও যার দু’টি সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার তপু বর্মনের। মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা মিলে ২৭০ মিনিটে করেছেন একটি মাত্র গোল।

এআরবি/এসএএস/আরএস