মতামত

চাকরি চাহিদা ও জোগান

 

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা পাঁচ বছর বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন চলছে। তার পক্ষে বিপক্ষে অনেক যুক্তিও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এত এত চাকরি প্রার্থী ছেলে মেয়ের সমাবেশ দেখে একটা বিষয় নিয়ে কেবল ভাবছি দেশে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আসলে কেমন?

Advertisement

কোন পরিসংখ্যান দিয়ে নিজেকে বা এই লেখাকে ভারী করতে চাইনা। শুধু এটুকু বুঝি অবস্থা ভাল নয়। দিনে যত ফোন পাই, তার ৯০ শতাংশই চাকরি প্রার্থীদের। কিছুদিন আগের কোটা আন্দোলন, এবার বয়সসীমার আন্দোলন, সবই সরকারি চাকরির জন্য। তাহলে কি বলা যায় দেশের ব্যক্তিখাত আজ আর প্রত্যাশিত কর্মসংস্থান দিতে পারছে না? গত প্রায় তিন দশক ধরে আমরা বাজার অর্থনীতির চর্চা করে যে বলে আসছি, দেশের প্রাইভেট সেক্টরই উন্নয়নের চালিকা শক্তি, সেই চাওয়া কী ব্যর্থ হয়েছে?

দেশে এখন শিক্ষিত সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। অসংখ্য তরুণ তরুণী স্নাতক হচ্ছে কিন্তু যুৎসই একটি চাকরি পাচ্ছে না। প্রতিবছর উচ্চশিক্ষিতদের বড় একটি অংশই বেকার থেকে যাচ্ছে। কর্মবাজারের সঙ্গে সংগতিহীন শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলে হয়তো দিনের পর দিন আলোচনা করা যাবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো একটা কর্মসংস্থানহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি আমরা।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল কর্মসংস্থানের বাজার সম্প্রসারিত করা। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন ভাবে উপস্থিত হয়েছে জাতির দরবারে। সরকারি চাকরিতে বেতন ভাতা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে, উপরিও আছে।

Advertisement

ব্যক্তিখাত সংকুচিত হয়ে পড়েছে, কিংবা এক জায়গায় আটকে আছে। ফলে সেখানে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছ কম, হলেও তা আকর্ষণীয় নয়। তাই কোটি কোটি তরুণ তরুণী এখন মরিয়া একটি সরকারি চাকরির জন্য। তারা একবার কোটা আন্দোলন করে, একবার বয়সসীমা বাড়াবার আন্দোলন করে।

আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি শ্রমবাজার উপযোগী নয়। এমনটাই বলা হয়। সবাই কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী চায়। মানবিক বিষয়গুলো থেকে পাস করা চাকরিপ্রার্থীরা তাদের অর্জিত একাডেমিক জ্ঞান নিয়ে টিকে থাকতে পারছে না। বেশিরভাগ চাকরিতে আবেদনের সুযোগই পায় না এসব চাকরিপ্রার্থীরা। অনেকটা অবজ্ঞা ও অধিকারহীনতায় অমানবিক জীবন-যাপনে বাধ্য হওয়া এসব উচ্চশিক্ষিতদের মনে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি ও দেশের প্রতি ক্ষোভের জন্ম নিচ্ছে নিয়ত।

চাকরি কোথায়? এমন প্রশ্নের একটিই উত্তর - চাকরি নেই। যদিও বলা হয়, কারিগরি বিদ্যা থাকলে চাকরির অভাব নেই, কথাটি পুরো সত্য নয়। ডিজাইনার, আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ারও বেকার প্রচুর। সত্যি বলতে কি চাকরি সৃষ্টির কোন উদ্দীপনা নেই অর্থনীতির কোন স্তরে।

কয়েকমাস আগে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ অর্জন করা সম্ভব নয়। এজন্য বর্তমানের প্রয়োজনের সাথে আগামীর প্রয়োজন মাথায় রেখে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তার এই বক্তব্যের গুরুত্ব আছে।

Advertisement

আগামী কয়েক দশকে বাংলাদেশে কোন খাতে কত সংখ্যক জনবল লাগবে তার একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং সে অনুযায়ী দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলার ভাবনা চোখে পড়ছেনা কোথাও। তেমনটা করতে গেলে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলে ফেলতেই হবে।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৩৭ লাক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। জানা মতে, ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) দেশে এক কোটি ৪০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো ছদ্ম বেকারত্ব। দেশের শ্রম বাজারে যারা এসেছে, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এদের ভাল বেতন নেই, উৎসব ভাতা নেই, ভাল কর্মপরিবেশ নেই, চাকরির নিরাপত্তা নেই।

সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষিত বেকারত্ব। ১৮ হতে ৩০ বছরের তরুণ-তরুণীদের মাঝে শিক্ষিতের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই এই সময়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

শিল্পায়নে গতি নেই, বিনিয়োগে টান। বিনিয়োগের উপযুক্ত জমি নেই, প্রতিবন্ধকতা স্তরে স্তরে। যদি আমরা এই বিষয়গুলিতে পিছিয়ে থাকি তাহলে বেকারত্বে যে এগিয়ে থাকবো, তাতে আর সন্দেহ কি!

আমাদের প্রবৃদ্ধি আলোচিত, দারিদ্র্য বিমোচনের হার লক্ষণীয়, আমাদের ভোগের জগতও দৃশ্যমান। কিন্তু বেকারত্ব আরো বেশি প্রকাশিত। কেন এমন হল, খুঁজে দেখা দরকার। এমনভাবে অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়ন করতে হবে যাতে শিল্প ও সেবা খাত আরো বিকশিত হয়। দক্ষ জনবলের অভাব দূর করতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতেও নজর দেয়া আবশ্যক।

সাম্প্রতিককালে তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ শিক্ষিত বেকারদের জন্য কিছুটা হলেও আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ হতে ২০২০ সালের মধ্যে এক কোটি ২৯ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু কর্মসংস্থানের বাজারে আসবে ৯৯ লক্ষ মানুষ। তাই বেকার সমস্যা কমাতে হলে বড় করে ভাবতে হবে।

সরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কেন গতি পাচ্ছেনা, সেই ভাবনা প্রয়োজন। আত্মকর্মসংস্থানে নানাভাবে প্রণোদনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে গুরুত্ব দেয়া দরকার, তা আমরা কতটা দিচ্ছি, তা নিয়েও চিন্তা করা প্রয়োজন।

এদেশের তারুণ্যের কণ্ঠে একটিই জিজ্ঞাসা- চাকরি কোথায়? এটি জানতে সব মানুষ আগ্রহী। জিডিপির সংখ্যাগত বৃদ্ধির ঝলমলানি এই তারুণ্যকে আনন্দ দেয় না। অন্যরকম মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যি বলতে কি যে বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় না, সেই বৃদ্ধি কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। কর্মসংস্থানের দিশাশূন্য উন্নয়ন হৃদয় ছুঁয়ে যায় না।

এইচআর/এমএস