জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ(আইবি)-এর গোপন নথি প্রকাশ হয়েছে। ওই গোপন নথি নিয়ে ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে ১৪ খণ্ড বইয়ের প্রথম খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির জনকের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার সেই সব গোপন নথিগুলো বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী। গোপন এ নথিগুলো উদ্ধার করার পর থেকে বই প্রকাশ পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর সময় লেগেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে শুক্রবার বিকেলে বইটির সম্পাদক ও শেখ হাসিনা এ বইয়ের মোড়ক উম্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাসহ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ এর সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান। এ ছাড়া হাক্কানী পাবলিশার্স-এর প্রকাশক গোলাম মোস্তফা, অাইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের ক্রিয়েটার নজরুল ইসলাম খান।
বাংলাদেশের ইতিহাস যেন সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারে সে জন্য গোপন নথি থেকে অমূল্য এসব ডকুমেন্ট দেশ-জাতি ও বহির্বিশ্বে পৌঁছে দেয়ার প্রয়াশে ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে ১৪ খণ্ডে বই আকারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। হাক্কানী পাবলিশার্স থেকে প্রকাশ করা হচ্ছে এই বই।
Advertisement
ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তার কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট পাঠাতো। এরই ভিত্তিতে বিনা বিচারে আটক, মামলাসহ নানামুখী নির্যাতন চলতো। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নামে স্পেশাল ব্রাঞ্চে খোলা ব্যক্তিগত ফাইলে সংরক্ষিত ডকুমেন্ট সংকলন করা হয়েছে।
বইটির প্রথম খণ্ড ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে সংকলিত হলেও এ খণ্ডে ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা ও মানবদরদি মনের পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়েছে।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বিহারে দাঙ্গার সময় রিফিউজি ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে প্রায় তিন মাস কাজ করেন। কলকাতা দাঙ্গার সময়েও লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ রিফিউজি ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। তরুণ শেখ মুজিব নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে কেমন করে বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন- সেই পথচিত্র যেমন এই বইয়ে এসেছে, সেই সঙ্গে এসেছে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলার মানচিত্র। এসব কারণে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সঙ্কলনকে বিশেষজ্ঞরা ‘অমূল্য সম্পদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা এটাও বলছেন, বঙ্গবন্ধুর অবদানকে যারা ভিন্ন চোখে দেখে। এই বইয়ের ইতিহাস তাদের চোখ খুলে দেবে।
Advertisement
গোপন নথিতে উল্লেখ ছিল ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ওই সময়ের নাজিম উদ্দিন সরকারের বাঙালিবিরোধী অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তিকরণ ইত্যাদিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১.৩.১৯৪৮ তারিখ সচিবালয়ের গেটের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি চলাকালীন গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবির সমর্থনে ভিসির বাঙলোয় অবস্থানকালীন ১৯.৪.১৯৪৯ তারিখে গ্রেফতার হন শেখ মুজিব।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চাপে কোনোরূপ আপস রফায় না গিয়ে তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব বাতিল করে। ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা ও খুলনা জেলার ‘দাওয়াল’দের সংগঠিত করে তাদের অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এছাড়া স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের জন্ম, মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাদন্ড, বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠি, তার কাছে বিভিন্ন নেতা-কর্মী ও আত্মীয়-স্বজনদের চিঠি, বিভিন্ন মিটিং ও জনসভায় দেয়া ভাষণ, কারাগারে আত্মীয়-স্বজন ও নেতা-কর্মীদের সাক্ষাৎকার সংক্রান্ত রিপোর্ট এই বইটিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
এফএইচএস/জেএইচ/পিআর