সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশে সর্বাত্মক অভিযানের জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই রাশিয়া এবং ইরানকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয়েছে সিরীয় বাহিনী। রুশ যুদ্ধবিমানের হামলায় তছনছ হয়ে গেছে ইদলিবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। গত তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইদলিবে মঙ্গলবার হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।
Advertisement
লড়াই বাঁধলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের এই শহরে মানবিক সংকট তৈরি হতে পারে বলে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পক্ষ। সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই ইদলিবে সামরিক অভিযান না চালানোর জন্য সিরিয়া এবং তার মিত্র ইরান ও রাশিয়াকে হুঁশিয়ার করেন।
কিন্তু সেই হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করে রুশ যুদ্ধ বিমান মঙ্গলবার ইদলিবে বেশ কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে। কেন অনেক ঝুঁকি সত্ত্বেও ইদলিবে যুদ্ধ শুরুর পথ থেকে পিছু হটতে রাজী হচ্ছে না সিরিয়া এবং রাশিয়া? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই বা কেন ইদলিব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন?
সিরিয়ার শেষ বিদ্রোহী অধ্যূষিত অঞ্চল ইদলিবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও তাদের মিত্র রাশিয়া। এর মাধ্যমে সাত বছর ধরে চলতে থাকা সিরিয়া যুদ্ধ হয়তো চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সে কারণেই রাশিয়া এবং সিরীয় বাহিনী সেখানে অভিযান চালানোর বিষয়ে এত তৎপর।
Advertisement
গত সাত বছরে যে জিহাদি সংগঠন ও বিদ্রোহী দলগুলো সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছে, তাদের সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি এই ইদলিব। জাতিসংঘের বক্তব্য অনুযায়ী, ইদলিবের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ।এদের মধ্যে ১০ লাখই শিশু।
ইদলিবের বেসামরিক নাগরিকদের অর্ধেকের বেশিই এসেছে এক সময় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে। যুদ্ধের সহিংসতা থেকে বাঁচতে সেসব জায়গা থেকে তারা হয় স্বেচ্ছায় পালিয়ে এসেছে অথবা তাদের বাধ্য করা হয়েছে এলাকা ছাড়তে।
ইদলিব প্রদেশের উত্তরে রয়েছে তুরস্কের সীমান্ত। আর দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি অংশ জুড়ে রয়েছে আলেপ্পো থেকে হামা হয়ে রাজধানী দামেস্ক যাওয়ার মহাসড়ক। আর এর পূর্বদিকে ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় শহর লাটাকিয়া। ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ যদি সিরীয় বাহিনীর হাতে চলে আসে তাহলে সিরিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি ক্ষুদ্র অঞ্চল বাদে আর কোথাও বিদ্রোহীদের ঘাঁটি থাকবে না। অর্থাৎ বিদ্রোহীরা কার্যত পরাজিত হবে।
ইদলিব প্রদেশটি কোনো একক নেতৃত্বের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। পরস্পরবিরোধী কয়েকটি দল- যাদের মোট আনুমানিক সৈন্যের সংখ্যা ৩০ হাজার তারা সম্মিলিতভাবেই ইদলিব নিয়ন্ত্রণ করে। আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত জিহাদি জোট হায়াত তাহরির আল-শামস (এইচটিএস) এসব দলের মধ্যে প্রভাবশালী।
Advertisement
প্রাদেশিক রাজধানী ও সীমান্ত দিয়ে তুরস্কে প্রবেশের পথ বাব আল-হাওয়াসহ ইদলিবের প্রধান প্রধান এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এইচটিএস। এইচটিএস-এর আনুমানিক ১০ হাজার সৈন্য রয়েছে যাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশী নাগরিক। জাতিসংঘ এটিকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
তুরস্ক সমর্থিত ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ) ইদলিবের দ্বিতীয় শক্তিশালী জোট। এইচটিএস-এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান তৈরির উদ্দেশ্যে কয়েকটি বিদ্রোহী দল এবছরই তৈরী করে এনএলএফ। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ব্যানারের অধীনে কার্যক্রম চালানো কয়েকটি ছোট দলসহ কট্টরপন্থী ইসলামিস্ট দল আহরার আল-শামস ও নূর আল-দিন আল-জিঙ্কি সংগঠনের সৈন্যরা এই জোটের সদস্য।
সিরীয় সরকার এখন ইদলিব অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন?
সিরিয়া যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ বর্তমানে প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে মোড় নিয়েছে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া পরিচালিত বিমান হামলা এবং সিরিয়ার আরেক মিত্র দেশ ইরানের হাজার হাজার সৈন্যের সমর্থনে অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হয়েছে সিরীয় বাহিনী। ৩০ অাগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ মুয়াল্লেম ঘোষণা করেন যে সরকারের প্রধান লক্ষ্য এখন ইদলিব স্বাধীন করা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, সিরীয় সরকার বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে ওই অঞ্চলের আধিপত্য দখল করতে চায়। কিন্তু পাশাপাশি ত্যাগের পরোয়া না করে এইচটিএসকে পরাজিত করার দৃঢ় সঙ্কল্পও ব্যক্ত করেন তিনি।
রাশিয়ার মতে, সিরীয় সরকারের পূর্ণ অধিকার রয়েছে নিজেদের এলাকায় জঙ্গীবাদের আশঙ্কা দমন করার। ইদলিবে সংঘর্ষ কামনোর উদ্দেশ্যে করা পূর্ববর্তী এক চুক্তির শর্ত কতটা পালিত হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে ইদলিবে তুরস্কের সৈন্যও রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ইদলিবে যেন বিদ্রোহী নিধনে সর্বাত্মক অভিযান না চালানো হয় সে বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
এরই মধ্যে ৩০ লাখেরও বেশী সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া তুরস্ক আশঙ্কা করছে ইদলিবে যুদ্ধ ছড়িয়ে পরলে নতুন করে তাদের সীমান্তে শরণার্থীদের ঢল নামবে।
ইদলিবে আক্রমণ কি থামানো সম্ভব?
রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ককে এখনই যুদ্ধে না জড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন সিরিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্টাফান ডে মিস্তুরা। সঙ্কট নিরসনে দু’টি সমাধান প্রস্তাব করেছেন তিনি। রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের লক্ষ্যে আলোচনায় অংশ নেয়া অথবা বেসামরিক নাগরিকদের অস্থায়ীভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে নির্ভরযোগ্য একটি চলাচলের পথ তৈরী করা।
তুরস্ক চায় সিরিয়া ও রাশিয়া যেন এই অভিযান স্থগিত করে। এই সঙ্কটের বিষয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে তিন দেশের শীর্ষ নেতারা শুক্রবার ইরানে বৈঠক করবেন। প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে হওয়া বিদ্রোহকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে সিরীয় সরকারের অতীত নৃশংসতা ইঙ্গিত করে যে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়ে তাদের বিশ্বাস করা যায় না। বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ দাবি করেছে তারা।
ইদলিবের বাসিন্দাদের সম্ভাব্য পরিণতি কী হবে?
ইদলিবে পুরাদস্তুর লড়াই শুরু হলে বেসামরিক লোকজনের ওপর তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। এমনিতে শহরের লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের নানা জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে হাজার হাজার বিদ্রোহী তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে অনেক জায়গায় জনসংখ্যার চাপ আশঙ্কাজনক বেড়ে গেছে।
জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা সাবধান করে বলেছেন- ইদলিবে বড় কোনো লড়াই বাঁধলে সিরিয়ায় নজিরবিহীন মানবিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘ বলছে, ৮ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হতে পারে। লাখ লাখ শরণার্থী তৈরি হতে পারে এই ভয়ে তুরস্ক সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
সিরিয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্টাফান দ্য মিস্তুরা হঠাৎ বড় কোনো অভিযান শুরু না করার জন্য রাশিয়া এবং ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দুটো সম্ভাব্য সমাধানের প্রস্তাব করেছেন: এক, রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং দুই, বেসামরিক লোকজন যাতে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
তুরস্ক কোনোভাবেই চাইছে না ইদলিবে বড় কোনো যুদ্ধ শুরু হোক। তুরস্ক, ইরান, সিরিয়া এবং রাশিয়ার নেতারা শুক্রবার ইরানে একটি বৈঠকে বসবেন বলে কথা রয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবার রাশিয়ার বিমান হামলা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইদলিব নিয়ে একবারেই পিছু হটতে ইচ্ছুক নয় সিরিয়া এবং তার মিত্ররা।
টিটিএন/পিআর