একজন দিয়ে হবে না, আরেকজন ব্যাটিং কোচ চাই। গুঞ্জন নয়, সত্য। টাইগারদের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মোট দু’জন ব্যাটিং কোচ নিয়োগের কথা ভাবছে। বিসিবির চিন্তা পরিস্কার। আজকাল তিন ফরম্যাটে খেলা হচ্ছে অহরহ। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি। আকার-আয়তন, গতি-প্রকৃতি, মেজাজ ও ধরনে পার্থক্য বিস্তর। ব্যাটিং টেকনিক ও স্কিল পুরোপুরি ভিন্ন।
Advertisement
ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সীমিত ওভারের। ৫০ ও ২০ ওভারের মধ্যেই যা করার করতে হবে। টেকনিক, ব্যাকরণ মেনে সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট মোকাবিলায় বাড়তি ও ভিন্ন কিছু করতে হয়। আর টেস্ট মানেই দীর্ঘ পরিসরের খেলা। যেখানে শটস খেলা, চটকদার মার, চার-ছক্কার ফুলঝুরি তথা আক্রমণাত্মক এপ্রোচের চেয়ে ধৈর্য্য, পরিপাটি টেকনিক ও লাগসই স্কিলটাই বেশী জরুরী ও কার্যকর। তার চেয়ে বড় কথা সীমিত ওভারের খেলা হচ্ছে সাদা বলে, প্রায়শই দিবারাত্রিতে। আর টেস্ট এখনো লাল বলে এবং বেশিরভাগ সময়েই দিনের আলোয়। পার্থক্য অনেক। তাই বিসিবির শীর্ষ কর্তা তথা নীতি নির্ধারকদের মাথায় চিন্তা ঢুকেছে ফরম্যাট ভেদে দরকার দুজন কোচ। একজন ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের জন্য, অন্যজন টেস্টের।
তার মানে প্রোটিয়া নেইল ম্যাকেঞ্জির সাথে আরও এক ব্যাটিং কোচের দেখা মিলছে শীঘ্রই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্টে ভরাডুবির পর ওয়ানডে সিরিজের আগে ব্যাটিং কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন ম্যাকেঞ্জি।
আগামীতেও মানে অন্তত আগামী বছর বিশ্বকাপ পর্যন্ত তিনিই তামিম, লিটন, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহদের ব্যাটিং কোচের দায়িত্বে থাকবেন। তবে সেটা সীমিত ওভারের ফরম্যাটে। তার মানে তামিম, মুশফিক ও সাকিবদের এশিয়া কাপের ব্যাটিং কোচ ও পরামর্শক ম্যাকেঞ্জি। গতকাল (রোববার) থেকে টিম বাংলাদেশের ব্যাটিং ও বোলিংয়ের স্কিল ট্রেনিং শুরু হলেও আজই প্রথম ব্যাটসম্যানদের নিয়ে কাজ করলেন এ দক্ষিণ আফ্রিকান।
Advertisement
গ্যারি কারস্টেন, গ্রায়েম স্মিথের মত গাণিতিক উইলোবাজ, হার্শেল গিবস, এ বি ডি ভিলিয়ার্স, ফাফ ডু প্লেসিস, কুইন্টন ডি কক, ল্যান্স ক্লুজনার ও ডেভিড মিলারের মত খুনে মানসিকতাসম্পন্ন ও আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান যে দেশের হয়ে খেলে বিশ্ব মাতিয়েছেন, সেই দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ক্রিকেটার ম্যাকেঞ্জি ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজ শেষে অল্প ক’দিন ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব পালন করলেও বাংলাদেশের মাটিতে আজই প্রথম কাজ করলেন।
লক্ষ্য-পরিকল্পনা ও কৌশল আসলে কি? তিনি সীমিত ওভারের ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কি শেখাতে চান? তাদের কাছে তার প্রত্যাশাটাই বা কি থাকবে? বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সে অর্থে মেরে খেলতে পারেন কম। ‘স্লগ ওভার’ ব্যাটিং আর ‘বিগ হিটিংয়ে’ সীমাবদ্ধতা পরিস্কার। তামিম, লিটন, সৌম্য আর আজকাল তিন নম্বরে প্রমোশন পাওয়া সাকিব সাধ্যমত চেষ্টা করেন।
তাদের ফ্রি স্টোক প্লে'র খেলার সামর্থ্যও আছে। শটসও খেলতে পারেন ভাল। তারপরও ৫০ ওভারের ম্যাচের প্রথম ১০ ওভারের ব্যাটিং পাওয়ার প্লে এবং টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে প্রথম ছয় ওভারের পাওয়ার প্লে'তে উড়ন্ত সূচনা হয় খুব কম। সে অর্থে নতুন বলে প্রতিপক্ষ বোলিংকে তছনছ করে দেয়ার মত আক্রমণাত্মক উইলোবাজিতেও আছে ঘাটতি।
একই ভাবে টপ-মিডল ও লেট অর্ডারে বিগ হিটারও নেই তেমন। এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর শুন্যতা, দূর্বলতা এবং ঘাটতি পূরণে ম্যাকেঞ্জির লক্ষ্য-পরিকল্পনা কি? তিনি সীমিত ওভারের ফরম্যাটে ব্যাটিংটাকে কিভাবে সাজাতে চান, ব্যাটসম্যানদের কাছে আসলে তার চাওয়াই বা কি?
Advertisement
সোমবার দুপুরের পর শুরু হওয়া প্র্যাকটিস সেশন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের সেই কৌতুহলি প্রশ্নের সাজানো গোছানো জবাবে অনেক কথার ভীড়ে ম্যাকেঞ্জি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘আসলে তিনি কি চান? তার চিন্তা-ভাবনাই বা কি?’
ম্যাকেঞ্জি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন টেকনিক দিয়েই অনেক কিছু করা যায়। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের পথে হাটার বিপক্ষে। ক্যারিবীয়রা যেভাবে তেড়ে ফুড়ে অনেকটা শারীরিক শক্তি-সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে বিগ হিটে অভ্যস্ত- তা অনুসরণ না করে স্কিল ও টেকনিক দিয়ে এগুনোর চিন্তা এ প্রোটিয়া ব্যাটিং কোচের। তাইতো মুখে এমন সংলাপ, ‘আমরা ওয়েষ্ট ইন্ডিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইনা। ক্যারিবীয়রা যেভাবে হিট করে আমরা সেভাবে না এগিয়ে স্কিল দিয়ে হিট করতে চাই।’
ম্যাকেঞ্জি হাওয়ায় উড়িয়ে বা বাতাসে ভাসিয়ে ছক্কা হাঁকানোর বদলে ৪০ গজের ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে কভার, পয়েন্ট ও মিড উইকেটের মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারি হাকানোয় অধিক মনোযোগী হতে চান। আগের দিন ক্যারিবীয়ান প্রিমিয়ার লিগে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ২৫৪ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করে দলকে জিতিয়েছেন। সেটাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে ম্যাকেঞ্জি বলেন, 'রিয়াদ এক ম্যাচে ১১ বলে ২৮ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস উপহার দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তার বিগ হিট খেলার সামর্থ্য আছে। শুধু রিয়াদ নয়, আমি জানি আমাদের দলে কজন ভাল হিটার আছে এবং আমি বিশ্বাস করি টেকনিক কাজে লাগিয়ে আরও বেটার হিটার হওয়া সম্ভব। আসলে বিগ হিটিংয়ের ক্ষেত্রে খুব ভাল জায়গায় চলে আসাটাই বড়।। ভাল পজিশনে এসে শটস খেলতে পারলে বিগ হিট ভাল ও পারফেক্ট হয়।’
ব্যাটিং এপ্রোচ কেমন হওয়া উচিৎ? তার ব্যাখ্যা দিয়ে ম্যাকেঞ্জি বলেন, 'এক ওভারে ছয় রানের দরকার পড়লে আমি সিঙ্গেলস ও ডাবলসে যাবার পরামর্শ দেব। দরকারে কভার ও মিড উইকেট আর বোলারের মাথার ওপর দিয়ে চালানোর কথা বলবো। আর যখন এক ওভারে ১২ করতে হবে, তখন লক্ষ্যটা অবশ্যই একটু কঠিন হবে। তখন বিগ শটে যেতেই হবে।’
সেটা কিভাবে? ম্যাকেঞ্জির ব্যাখ্যা, '১২ রানের পিছু ধেয়ে শুধু ছক্কা হাকানোর চেষ্টায় থাকে বাড়তি ঝুঁকি। দেখা গেল প্রথম দুই বল ব্যাটেই লাগলোনা। দুটি ডট বলের পর হয়ত এক ছক্কার দেখা মিললো। তারচেয়ে তিনটি বাউন্ডারি হাকানোই সেরা বিকল্প। আমি দেখতে চাই, ছয় বলে ১২ রান করতে গিয়ে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা ছক্কা হাকাতে গিয়ে দুটি ডট বল দিয়ে ছক্কা হাকানোর চেষ্টা না করে পর পর তিন বলে তিন বাউন্ডারি হাকাবে। আমরা তিনটি ভাল ক্রিকেটীয় শট থেকে বাউন্ডারি তুলে নিয়েই ১২ রানের লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলতে পারি।’
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের শারীরিক শক্তি ও শটস খেলার সামর্থ্য বিবেচনায় ধরলে ম্যাকেঞ্জির এ কৌশল হতে পারে অতি কার্যকর দাওয়াই। এখন দেখার বিষয় টাইগাররা কি সে দাওয়াই খাবেন?
এআরবি/এসএএস/এমএস