ফিচার

মৃত্যুঞ্জয়ী নারীর নাম রমা চৌধুরী

জীবনযুদ্ধে জয়ী এক নারীর নাম রমা চৌধুরী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘ চলার পথে প্রতিটি বাঁকে যুদ্ধ করেছেন কিছু না দেওয়া এই সমাজের বিরুদ্ধে, পারিপার্শ্বিকতার বিরুদ্ধে। হার না মানা মনটায় উদ্যম থাকলেও আজ ভোর চারটা নাগাদ তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শহীদ মিনারে সর্বস্তরের শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে বোয়ালখালীর নিজ গ্রামে, সেই মেঠোপথ ধরে যেখান থেকে শুরু। অথচ তিনি লিখেছিলেন, ‘যাব না, ভাই, যাব না/ স্বর্গে আমি যাব না/ দুধের নদী, ক্ষীরের সাগর/ যতই সেথা থাকুক না।/ চাই না যেতে স্বর্গে আমি/ যদি বকুল সেথা নাহি ফোটে’ (স্বর্গে আমি যাব না)

Advertisement

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব অগণিত মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন, তাদের একজন চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনটাকে ওলটপালট করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে নিজের জীবনযুদ্ধের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই সময়ের বলি হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তার তিন ছেলেকেও।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। থাকতেন পৈতৃক ভিটা বোয়ালখালীর পোপাদিয়ায়। তার স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। তাঁকে জোর করে নিয়ে যায় পাশের নির্জন ঘরে। হারান সম্ভ্রম। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ওই দিনই হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। ঘর-বাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাঁকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে কাটাতে হয় জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে।

> আরও পড়ুন- বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের রাশেদের সুনাম

Advertisement

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগের রাত থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার সন্তান সাগরের। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা যায় সাগর। নিজের লেখা ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থের এক জায়গায় (২১১ পৃষ্ঠায়) রমা চৌধুরী লিখেছেন, ‘ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, ‘আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)।’

একই রোগে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তির পরে দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।

হিন্দুধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করতেন না রমা চৌধুরী। তাই মৃত্যুর পর তাঁর তিন সন্তান ও মাকে দেওয়া হয়েছে মাটিচাপা। এরপর আর জুতো পায়ে দেননি এই বীরাঙ্গনা। তার ভাষায় ‘আমার তিন ছেলে মাটির নিচে। তাদের শরীরের উপর দিয়ে জুতা পায়ে আমি হাঁটি কী করে? আমার সন্তানদের কষ্ট হবে না?’

নিজের এবং জীবিত এক ছেলের মুখের ভাত জোটাতে প্রায় ৩০ বছর ধরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নিজের লেখা বই বিক্রি করেছেন তিনি। কখনো কারও কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেননি। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাশীল এ সংগ্রামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্যের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের বই ফেরি করা নিয়ে বলেছেন, ‘কারো কাছে জীবনে হাত পাতিনি। আমি নিজের লেখা বই বিক্রি করি। যেদিন বিক্রি করতে পারি সেদিন খাই, যেদিন পারি না সেদিন উপোষ থাকি।’

Advertisement

> আরও পড়ুন- নারীদের আশ্রয়স্থল এসপি শামসুন্নাহার

স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানির বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে এ পর্যন্ত রমা চৌধুরীর ২০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। সেই পেশায় ছিলেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। শরীর ভালো থাকলে খালি পায়ে কাঁধের ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ৭৪ বছর বয়সী এই সংগ্রামী নারী। তার ভাষায়, ‘আমার সন্তানেরা শহীদের মর্যাদা পায়নি, কিন্তু তারা আমার কাছে শহীদ। কারণ, একাত্তর আমাকে দিয়েছে পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা।’

২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তার ছোটগল্প সংকলন ‘আগুন রাঙা আগুন ঝরা অশ্রু ভেজা একটি দিন’। এই গল্পে তিনি চিরায়ত গল্পবলার কৌশল অবলম্বন করেছেন। শুরুটা করছেন এভাবে- ‘সেই কিশোরীটি যে বধূ হতে চেয়েছিল অথচ পারলো না, তারই জীবনের করুণ-মধুর কাহিনী আজ বলে যাবো।’ এরপর তিনি গল্পবলার কথ্যরীতি অবলম্বন করে গল্পটি লিখে চলেন। লেখার ভেতর যে গতিটা আছে সেটি পাঠেও সঞ্চারিত হয়। পড়তে পড়তে একটুও ক্লান্তি আসে না। রমা চৌধুরীর গল্পে ছোট ছোট কোলাজের মতো সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র পাওয়া যায়। মূলত নারীজীবন তাঁর কথাসাহিত্যের প্রধানতম বিষয়।

‘মেয়েদের মা হওয়ার সুযোগ দাও’ শীর্ষক গদ্যে তিনি বলেছেন, ‘বন্ধ্যা নারী যেমন আছে, বন্ধ্যা পুরুষও তেমন আছে। বন্ধ্যা নারীর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তানের বাবা হতে পারছে। কিন্তু বন্ধ্যা স্বামীর স্ত্রীর জন্য সেই স্বাধীনতা কেন থাকবে না?’

‘নীল বেদনার খাম’ বইটি মা ও ছেলের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনকে লেখা পত্রাবলী দিয়ে সাজানো। রমা চৌধুরীর ছেলে দীপংকর টুনুর কিশোরকালে লেখা চিঠিগুলো নানাভাবে সংগ্রহ করে এই বইতে সংকলন করেছেন একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী। জীবন ধারণের পাশাপাশি তিনি তাঁর অকালপ্রয়াত ছেলের নামে ‘দীপংকর স্মৃতি অনাথআলয়’ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

এসইউ/পিআর