দেশজুড়ে

সোনালী আঁশে মিশেছে ১০ হাজার নারীর সোনালী স্বপ্ন

যশোরের সীমান্তবর্তী বেনাপোল ও শার্শার বিভিন্ন জনপদের জলাশয়ে জাগ দেয়া পাট ধোয়ার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রায় ১০ হাজার নারী শ্রমিক। সোনালী আঁশের সঙ্গে মিশে তারা আজ জীবনের সোনালী স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। চলতি পাট মৌসুমে বেনাপোল-শার্শার পাট কাটা, জাগ দেয়া ও পাটকাঠি থেকে পাট ছাড়ানো শুরু হয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় সময়মতো পাট কেটে তা বিভিন্ন জলাশয়ে জাগ দিতে পেরেছেন কৃষকরা।

Advertisement

যশোরের বেনাপোলের উত্তর বারোপোতা গ্রামের মরিয়ম বেগম শার্শা উপজেলার টেংরা গ্রামের আছিয়া বেগম আর সামটা গ্রামের ছায়রা খাতুনদের এখন দম ফেলার সময় নেই। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাট ধোয়া আর আঁশ ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত তারা। গত কয়েক বছর আবহাওয়ার প্রতিকূলের কারণে এ অঞ্চলে পাট চাষ তেমন একটা ভালো হয়নি। এবার নতুন আশায় সোনালি আঁশ খ্যাত পাট চাষে বাম্পার ফলন পেয়ে নারীরাও ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন বয়সের নারীরা পাটের বোঝা বেঁধে পানিতে জাগ দেয়া থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছেন। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় সময়মতো পাট কেটে তা বিভিন্ন জলাশয়ে জাগ দিতে পারায় কৃষকরা এখন সোনালী আাঁশের সোনালী স্বপ্নে বিভোর। গ্রামের অধিকাংশ নারীরা সোনালি পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

উপজেলা কৃষি সস্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে শার্শায় পাট কাটা, জাগ দেয়া ও পাটকাঠি থেকে আঁশ ছাড়ানোর কাজে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ১০ হাজার নারী। পুরুষদের পাশাপাশি এই কাজে অংশ নিয়ে কিছুটা বাড়তি আয়ের মুখ দেখছেন তারা।

বেনাপোলের উত্তর বারোপোতা গ্রামের মোরিয়ম বেগম জানান, এক আঁটি পাট ছাড়ালে ৩০ টাকা পাওয়া যায়। একজন নারী দিনে ২০-৩০ আঁটি পাটের আঁশ ছাড়াতে পারেন। অন্য সময় ক্ষেতমজুর হিসেবে কাজ করলে যে টাকা মেলে, পাট ধোয়ার কাজে তার তিনগুণ বেশি টাকা পাওয়া যায়। এ কারণেই সংসারের কাজের পাশাপাশি পাট মৌসুমে পাট ছাড়ানোর কাজে যোগ দিচ্ছেন নারীরা। অনেকে আবার পাটকাঠি নেয়ার শর্তে কাজটি করে থাকেন।

Advertisement

ক্ষোভ প্রকাশ করে দেউলির অমেলা জানান, স্বামী মারা গেছে ১০ বছর আগে। মাঠে কাজ করে সংসার ও ছেলে-মেয়েদের মানুষ করছি। পাটের মৌসুমে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজ করে এ সব খরচ চলছে। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করেও নারীরা ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। এবিষয়ে নারীদের পক্ষে কেউ কিছু বলেও না।

টেংরা গ্রামের আছিয়া বেগম জানান, স্বামী মাঠে কাজ করে। সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আনতে ঘরে না বসে থেকে এ কাজ করে সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করছি। এ টাকায় ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও কাপড়-চোপড়ের খরচ উঠে যায়।

শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাসের মাঝা-মাঝি সময়ে পাট কেটে ১০-১৫ দিন পানির নিচে ডুবিয়ে রেখে নিখুঁত হাতে নারীরা পচা পাট থেকে আঁশ ও আলাদা করেন। পাট গাছের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এ আঁশই সবচেয়ে মূল্যবান। প্রতি মণ পাট এবার ১২০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু পাট চাষে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা বিরাট অবদান রাখলেও অধিকাংশ নারী শ্রমিক ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। নারীরা পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি তাদের চেয়ে কম পাচ্ছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়িয়ে একজন পুরুষ মজুরি পান ৩৮০- ৪১০ টাকা আর নারী শ্রমিক পান ২৫০-৩০০ টাকা। তারপরও তারা থেমে নেই। নারীরা পরিবার ও সমাজের উন্নয়নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ভাগ্যোন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছেন।

শার্শা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ হীরক কুমার সরকার জানান, উপজেলায় দুই হাজার নারী নিজের জমিতে চাষাবাদ করেন। অন্যের জমিতে মজুর হিসেবে কাজ করেন আরও প্রায় চার হাজার নারী। তবে মৌসুমে পাটকাঠি থেকে পাট ছাড়ানোর কাজ করেন এ জনপদের প্রায় ১০ হাজার নারী। এবার উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে পাট চাষ হয়েছে। শার্শায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। বিপরীতে চাষ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। গতবার পাটের মূল্য কম পাওয়ায় চাষিরা এবার পাট চাষ কম করেছে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।

Advertisement

মো. জামাল হোসেন/আরএ/পিআর