৮ মাসের শিশু আকিফাকে কোলে নিয়ে রিনা বেগমের রাস্তা পার হওয়ার ভিডিওটি আমি অনেকবার দেখেছি। দেখেছি, কারণ অনেকেই বলছিলেন, রিনা বেগমেরই দোষ, তিনি কেন বাসের সামনে দিয়ে হাঁটছিলেন। কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভিডিওটি দেখার পর আমার মনে হয়েছে, রিনা বেগম যথেষ্ট সাবধানী ছিলেন।
Advertisement
রাস্তা পার হওয়ার আগে অন্তত দুইবার তিনি দুইপাশ দেখে নিয়েছিলেন। তিনি থেমে থাকা বাসটির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনই হঠাৎ থেমে থাকা বাসটি চলতে শুরু করে। চালক বা তার সহকারী সামনের দিকে তাকাননি। চালক কোনো হর্নও দেননি। শেষ মূহুর্তে বাসটি রিনা বেগমকে ধাক্কা দেয়। তিনি চিৎকার করেছিলেন। তখনও বাসটি থামাতে পারতেন চালক। তা না করে রিনা বেগমকে ধাক্কা দিতে দিতে বাসটি এগিয়ে চলে। তাল সামলাতে না পেরে কোলে থাকা আকিফা ছিটকে পড়ে।
কুষ্টিয়া আর ঢাকার হাসপাতালে সবার প্রাণান্তকর চেষ্টা ব্যর্থ করে পৃথিবীর রূপ-রস না দেখেই চলে যেতে হয় আকিফাকে। আমি খালি রিনা বেগমের কথা ভাবি, আর কষ্টে আমার বুক ভেঙ্গে যায়। মায়ের কোল শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সেই মায়ের কোল থেকেই যখন ছিটকে পড়ে মরে যায় শিশু, সেই মায়ের বেঁচে থাকা যে কত কষ্টকর, তা অনুভব করাও অসম্ভব।
পত্রিকায় লেখা হয়েছে, রিনা বেগমের কান্না থামছে না। আসলে থামবেও না। চোখের পানি হয়তো একসময় শুকিয়ে যাবে। কিন্তু কোলের সন্তানকে বাঁচাতে না পারার বেদনা বুকে নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে তাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পোস্টমর্টেম শেষে সাদা কাপড়ে মোড়ানো শিশু আকিফার মরদেহ যখন তার পিতা হারুন অর রশিদের কোলে দেয়া হয়, তখনকার দৃশ্যটি একটু কল্পনা করুন। সন্তানের লাশ যে কত দুর্বহ, তা আসলে অন্য কারো পক্ষে অনুভব করাও অসম্ভব। প্রতিদিন বাংলাদেশে এমন কত অসম্ভব দৃশ্য সৃষ্টি হচ্ছে তার কয়টি আমরা জানি?
Advertisement
ঈদের ছুটির ১৩ দিনে দেশে ২৩৭টি দুর্ঘটনায় ২৫৯ জন মারা গেছে। তার মানে ২৫৯টি পরিবারে এবার ঈদ আনন্দ বয়ে আনেনি। দৈনিক প্রথম আলোর হিসেবে গত ৫৫৫ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৫ হাজার ৩৩ জন। এ যেন এক অন্তহীন মৃত্যুর মিছিল। শিক্ষার্থীদের মহৎ আন্দোলন আসলে কোনো কাজেই আসেনি। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, 'খুলে দেয়া চোখ আবার বন্ধ'। কিন্তু আমার ধারণা শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। নির্বিকারত্বের গভীর এক ঘুমে আচ্ছন্ন আমরা সবাই।
গত ২৫ আগস্ট বুলগেরিয়ায় একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গিরিখাদে পড়ে গেলে ১৭ জন মারা যায়। এরপর থেকে রাস্তা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল স্থানীয় লোকজন। আন্দোলনের মুখে বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী বোয়কো বরিসভ তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। বরখাস্ত হওয়া মন্ত্রীরা হলেন, পরিবহনমন্ত্রী ইভায়লো মসজোভস্কি, আঞ্চলিক উন্নয়নমন্ত্রী নিকোলায় নানকভ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যালেন্তিন রাদেভ।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'দেশের সড়কব্যবস্থার দৈন্যদশার কারণে ঘটা যে দুর্ঘটনার কারণে আন্দোলনের সূত্রপাত, তার দায়িত্ব রাজনীতিকদের নেয়া উচিত'। বরখাস্ত হওয়া মন্ত্রীরাও অবশ্য দায়িত্ব অস্বীকার করেননি। বরখাস্ত হওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'আমরা সব রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করছি। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নিইনি'। বুলগেরিয়ার মন্ত্রীরা রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করেন। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ দায়িত্ব নেয় না।
গত ২৯ জুলাই ঢাকায় রমিজউদ্দিন স্কুলের অপেক্ষমান শিক্ষার্থীদের ওপর বাস তুলে দিলে দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। প্রতিবাদে মাঠে নামে শিক্ষার্থীরা। দুর্ঘটনার খবরে হাস্যোজ্জ্বল প্রতিক্রিয়া দিয়ে তাদের সেই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালেন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বুলগেরিয়ার মানুষের মত এত অবুঝ নয়। তারা তিন মন্ত্রী নয় একমন্ত্রীর, তাও অপসারণ নয়, পদত্যাগ চেয়েছিল।
Advertisement
শুধু এবারের হাসি নয়, এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জনআবেগের বিপরীতে ঘাতক চালকদের পক্ষ নিয়ে অসংবেদনশীল মন্তব্য করে নিন্দা কুড়িয়েছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি নৌ পরিবহন মন্ত্রী হলেও তার সব আগ্রহ সড়ক পরিবহন নিয়ে। স্বার্থের সংঘাতের ধারনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি একই সঙ্গে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রকও।
সরকারের সামনে সুযোগ ছিল নির্বাচনের আগে শাজাহান খানকে অপসারণ করে ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল করার। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে একজন মন্ত্রীকে অপসারণ করলে, তা খুব গ্লানিরও হতো না। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এত কিছুর পরও শাজাহান খান বহাল তবিয়তেই আছেন।
রহস্যটা অবশ্য পরিষ্কার। শাজাহান খান আসলে সরকারের লাঠিয়াল। আওয়ামী লীগের সমাবেশে বাসভর্তি করে লোক আনবেন শাজাহান খান। বিএনপির সমাবেশ হলে বাস বন্ধ করে লোকের আসা কষ্টকর করবেন শাজাহান খান। খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাও করবেন শাজাহান খান। এমনকি কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিপক্ষেও মাঠে নামেন শাজাহান খান। সড়ক দুর্ঘটনার দায় নিয়ে বুলগেরিয়ায় তিন মন্ত্রী সরে যেতে পারলে বাংলাদেশে প্রতিদিনের মৃত্যুর মিছিলের দায় কেউ নেবেন না কেন?
এইচআর/জেআইএম