অর্থনীতি

দু’দিক থেকেই ফায়দা লুটছে ট্যানারি মালিকরা

>> বেকায়দায় আড়তদাররা>> চামড়া নেয় টাকা দেয় না>> প্রান্তিকে কাঁচা চামড়া রফতানিই সমাধান

Advertisement

প্রতিবছর চামড়া কেনার নামে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ঋণ নিচ্ছেন ট্যানারিগুলো। সময়মতো তা পরিশোধ করছে না। অন্যদিকে আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া নিচ্ছে কিন্তু পাওনা টাকা দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে নানান তালবাহানা করে দুদিক থেকেই ফায়দা লুটছে ট্যানারি মালিকরা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যানারিগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, ফেরত দেয় না। আবার আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া কিনে টাকা দেয় না। এতে করে অর্থ সঙ্কটে মূল্য কমছে কাঁচা চামড়ার। ফলে ঠকছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা আর বিপাকে পড়েছে আড়তদাররা।

ট্যানারি মালিকরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে চাহিদা কম থাকায় রফতানি আয় কমেছে। এ ছাড়া সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে অর্থ সঙ্কট রয়েছে। সব মিলিয়ে চামড়া শিল্পে স্থাবিরতা বিরাজ করছে। সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা পেলে সমাধান হবে বলে মনে করছেন তারা।

Advertisement

রাজধানীর পোস্তার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলেন, নিজস্ব পুঁজি খাটিয়ে সারা বছর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেন আড়তদাররা। নিয়মানুসারে কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে চামড়ার দেনা অর্থ পরিশোধ করেন ট্যানারি মালিকরা। কিন্তু নানা অজুহাতে এবার ঈদে বেশিরভাগ ট্যানারি পাওনা অর্থ পরিশোধ করেননি। এখন কোরবানির কাঁচা চামড়া কিনবে ট্যানারিগুলো। তবে আমরা (কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা) অর্থ পাব কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। এমন পরিস্থিতিতে কাঁচা চামড়ার মূল্য হ্রাস ঠেকাতে সময়িক রতানির পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন হাইড অ্যান্ড স্কিন রিটেইল ডিলার মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নোওয়াব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ট্যানারি মালিকদের কথা অনুযায়ী তাদের গত বছরের ৪০ শতাংশ চামড়া অবিক্রিত পড়ে আছে। তাহলে তারা এ বছর চামড়া কিনে কী করবে? এসব কথা ট্যানারি মালিকরা প্রতি বছরই বলেন। এসব কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য তা হলো- কম দামে চামড়া কেনা। আবার টাকাও পরিশোধ করবে না।

কাঁচা চামড়ার এ ব্যবসায়ী বলেন, নিজের পুঁজি খাটিয়ে চামড়া কিনি। লবণ দিয়ে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা করেছি। এখন ট্যানারিগুলো চামড়া কিনে নেবে। কিন্তু টাকা পাবেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ট্যানারিগুলোর এ ধরনের আচরণ অব্যাহত রাখলে আগামীতে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা পথে বসবে। সাভারে কারখানা স্থানান্তরের কারণে পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে সমস্যা হচ্ছে। এটি ঠিক আছে। কিন্তু এজন্য পুরো খাতকে অস্থির করা ঠিক নয়। চামড়ার সঠিক মূল্য ও সময়মতো টাকা না পেয়ে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পথে বসছে। এভাবে চলতে থাকলে এ ব্যবসা ছেড়ে লোকজন অন্য পেশায় চলে যাবে। ফলে ধংস হবে রফতারি এ শিল্প। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য কাঁচা চামড়া রফতানির আদেশ দেয়া উচিত। এতে করে কাঁচা চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে। আবার যখন ট্যানারিগুলোর পুরোপুরি সক্ষমতা ফিরবে তখন রফতানি বন্ধ করে দেবে।

Advertisement

নোওয়াব হোসেন বলেন, ট্যানারির মালিকরা নানা কৌশল করে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। ব্যাংক থেকে চামড়া কেরার নামে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের পাওনা টাকা পরিশোধ করছে না। তারা আমাদের টাকা আটকিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছে। বাড়ি-গাড়ি ও রিসোর্ট তৈরি করছে। আমরা আড়তদাররা কিছুই পাচ্ছি না অথচ ট্যানারির মালিকরা দুদিক থেকেই ফায়দা লুটছে।

ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রচলিত ব্যাংকিং বিধিবিধান না মেনেই প্রতিবছরই চামড়া খাতে ঋণ দেয়ার হচ্ছে। যার বেশির ভাগ ঋণেরই তেমন কোনো জামানত নেই। খেলাপি গ্রাহকদের কারখানার বেশির ভাগই বন্ধ। কিছু প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলা করেও ঋণ আদায় করতে পারছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস পর্যন্ত সরকারি ব্যাংকগুলো চামড়া খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের স্থিতি ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি প্রায় ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই খেলাপি। নিয়মিত আছে ৯শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা রয়েছে বিশেষ হিসাবে রয়েছে। এছাড়া আদায়ে ব্যর্থ হয়ে খেলাপি ঋণের মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। খেলাপি ও অবলোপন করা ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কোনো হদিস নেই।

এত কিছুর পর এবারও কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে ঋণ দেয়ার সিন্ধান্ত নিয়েছে সরকারি চার ব্যাংক। শিল্পের স্বার্থে ৬০০ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি এ ঋণ বিতরণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, অর্থ সঙ্কটের কারণে পাওনা টাকা দিতে কিছুটা সমস্যা হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু কোনো পাওনা দিচ্ছি না একথা সঠিক নয়। আমদানির প্রধান দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে চামড়া দরপতন হয়েছে। চাহিদাও কমেছে। ৪০ শতাংশ চামড়া অবিক্রিত পড়ে আছে। ফলে রফতানি আয়ও কম হয়েছে। এছাড়া সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে এবার উৎপাদন কার্যক্রমে সমস্যা হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে এ খাত অর্থ সঙ্কটে ব্যবসা থমকে আছে। তবে এ অবস্থায়ও সরকারি নির্ধারিত মূল্যেই লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হবে। কারণ কোরবানির পশুর চামড়া মান তুলনামূলক ভালো। বিশ্ব বাজারে এর চাহিদা বেশি।

আড়তদারদের পাওনা টাকা আটকিয়ে অন্য খাতে ব্যবসা করছে ট্যানারি মালিকরা এমন অভিযোগের বিষয়ে বিটিএ’র এ নেতা বলেন, আড়তদারদের সঙ্গে ট্যানারি মালিকদের ব্যবসা ৫০ বছরের। এতদিন তাদের সঙ্গে সমস্যা হয়নি। কেউ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেই পারে। তবে বিষয়টি সত্য কি না তা তদন্তের বিষয়।

কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়ে তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না। এটি করা হলে দেশের চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ এর সঙ্গে অনেক লিংকেজ ব্যবসা জড়িত।

ব্যাংক ঋণ প্রসঙ্গে এ ট্যানারি মালিক বলেন, চামড়া কেনার ঋণ মূলত এক বছরের জন্য দিয়ে থাকে ব্যাংক। যারা গত বছরের টাকা পরিশোধ করেছে তারাই ঋণ পায়। এ বছর সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে অর্থ সঙ্কটের পড়েছে। দুই তিনজন ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। নতুন করে অনেকে ব্যাংক ঋণ পাবে না। ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার যে সিন্ধান্ত নিয়েছে তা কাগজে কলমেই রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সেক্রেটারি হাজী মো. টিপু সুলতান জাগো নিউজকে বলেন, দুই একটি ট্যানারি লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করেছে। পোস্তায় ৮ লাখের বেশি চামড়া রয়েছে। এটি বিক্রি হলে ঢাকার বাহিরের সংরক্ষণ করা চামড়া আসতে শুরু করবে।

তিনি বলেন, এবার চামড়ার ব্যবসা মন্দা। লবণের দাম বেশি। সব মিলিয়ে খরচ বেড়েছে। কিন্তু ট্যানারির মালিকরা টাকা দেয়নি। আমরা নিজের টাকা খাটিয়ে কাঁচা চামড়া কিনেছি। এখন তারা চামড়া কিনে যদি টাকা না দেয় তাহলে ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে। কারণ ট্যানারিগুলোকে সরকার বিভিন্ন সহযোগিতা করে। ব্যাংকও ঋণ দেয় আমরা কিছুই পাই না। নিজের পুঁজিতে ব্যবসা করি। এই টাকা অন্যের কাছে পড়ে থাকলে ব্যবসা করবো কীভাবে। তাই ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা টাকা পরিশোধের দাবি করেন তিনি।

এসআই/এমবিআর/এমএস