বিশেষ প্রতিবেদন

বঞ্চনার চাপা কষ্টে দেড় শতাধিক যুগ্ম-সচিব

তিনি সরকারের একজন যুগ্ম সচিব। বসেন সচিবালয়ে ৬ নম্বর ভবনে ছোট্ট একটি কক্ষে, কক্ষটি বিভিন্ন বইয়ে ঠাসা। বুধবার দুপুরের দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিষণ্ন তিনি, বসে আছেন। খানিকক্ষণ কোনো কথাই বললেন না। কষ্ট নিয়ে বললেন, ‘গতকাল (বুধবার) রাতেই দেখেছি, তালিকায় এবারও আমার নাম নেই। পঞ্চমবারের মতো বঞ্চিত হলাম।’

Advertisement

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই যুগ্ম সচিব বলেন, ‘আমার চাকরি জীবনে কোনো দাগ নেই, কখনও কোনো অনিয়ম করিনি। তারপরও জানি না কেন আমার পদোন্নতি হয় না? তবে মনে করি, যারা পদোন্নতি দেন তারা আমাকে তাদের লোক মনে করেন না। আমি শতভাগ নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই, শুধু তাদের ধারণা, আমি তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ নই। তাই আমাকে পদোন্নতি দেয়া হয় না।’

বুধবার রাতে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির আদেশের পর বৃহস্পতিবার এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান এই যুগ্ম সচিব। কর্মকর্তারা বলছেন, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে দেড় শতাধিক যুগ্ম সচিব বঞ্চিত হয়েছেন। বুকে বঞ্চনার চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৫৪ জন যুগ্ম সচিব। এ ছাড়া লিয়েনে বিদেশে থাকা আরও ৯ জন যুগ্ম সচিব দেশে ফিরলে তাদের পদোন্নতির আদেশ কার্যকর হবে।

Advertisement

তবে পদোন্নতির দায়িত্বপ্রাপ্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, নানান কারণে কর্মকর্তারা পদোন্নতির বিবেচনায় আসেন না। যোগ্য কেউ পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন যুগ্ম সচিব বলেন, ‘আমার সচিব আমার ব্যাচের। তার মেধাতালিকা ছিল আমার থেকে ১০০ জনেরও পরে। আমি এখনও যুগ্ম সচিব হয়ে তার অধীনে কাজ করি। এবারও পদোন্নতি পেলাম না। বলেন কীভাবে কাজ করব? আর এই কষ্টের কথা কাকে বলব?’

এভাবে আরও অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতির বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন। তারা দাবি করছেন, সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা পদোন্নতি পাননি। ধারণা থেকে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে তাদের বারবার পদোন্নতি বঞ্চিত করা হচ্ছে। জুনিয়র কর্মকর্তারা বস হয়ে যাচ্ছেন। এতে তারা মানসিকভাবে বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পড়ছেন। কাজে মন দিতে পারছেন না।

১৯৮৫ ব্যাচের পদোন্নতিবঞ্চিত একজন যুগ্ম সচিব বলেন, ‘এসব বলে আর কী হবে, এখন আল্লাহর কাছে বলি।’

Advertisement

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে দশম ব্যাচকে মূলত বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তবে এর আগের ব্যাচগুলোর বঞ্চিতদের (লেফট আউট) মধ্য থেকেও অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে।

পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে দশম ব্যাচের কর্মকর্তা রয়েছেন ৯৭ জন। এ ছাড়া বাকি কর্মকর্তারা বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচ, ১৯৮৪ ব্যাচ, ১৯৮৫ ব্যাচ, ১৯৮৬ ও নবম ব্যাচের।

নবম থেকে ১৯৮২ ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন লেফট আউট কর্মকর্তা (সবব্যাচের বঞ্চিত) ছিলেন, এর মধ্যে অর্ধশতের মতো পদোন্নতি পেয়েছেন। এ ছাড়া পদোন্নতির বঞ্চনা রয়েছে দশম ব্যাচেও।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব শেখ ইউসুফ হারুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশা করি পদোন্নতির কারণে কর্মকর্তারা কাজে আরও উৎসাহিত হবেন। পদোন্নতির পর আজই দুজন কর্মকর্তা পিআরএলে (অবসরোত্তর ছুটি) গেছেন, তারা লাভবান হবেন। এবার অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য ছিল দশম ব্যাচ। দশম ব্যাচের কর্মকর্তারা ৫ বছর ধরে যুগ্ম সচিব।’

দেড় শতাধিক কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা আছে, অনেকে বিভাগীয় মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত। তিনি যখন আপনাদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন কিন্তু এটা বলেন না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসিআরসহ (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) সবকিছু মিলিয়ে মার্ক কমপক্ষে ৮৫ হতে হয়, সেটা অনেকের নেই।’

‘এই মার্ক থেকে দশমিক ৫ কম পেলেও তিনি প্রমোশনের জন্য বিবেচিত হবেন না। কারও কারও এসিআর খারাপ, সেখানে বিরূপ মন্তব্য আছে। অনেকের বিরুদ্ধে দুদকে মোকদ্দমা আছে, আদালতে মোকদ্দমা আছে। গোয়েন্দারাও কর্মকর্তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন দেয়, সেটাও দেখা যায়, অনেকের ক্ষেত্রে খারাপ। এসব কারণে অনেকে পদোন্নতি পান না’,- বলেন এপিডি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব।

পদ ১২১, কর্মকর্তা ৬৩৪

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত সময়ে পদোন্নতির কারণে এখন প্রশাসনে নির্ধারিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেশি। পর্যাপ্ত পদ না থাকায় পদোন্নতির পর অধিকাংশ কর্মকর্তাকেই আগের জায়গায় কাজ করতে হচ্ছে। ফলে একেক মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিব রয়ে গেছেন। এতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনে। এর উপর ফের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হলো।

পদোন্নতির পর প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা হলো ৬৩৪ জন। কিন্তু এর বিপরীতে অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদের সংখ্যা ১২১টি। তাই পদোন্নতি পাওয়া বেশির ভাগ অতিরিক্ত সচিবকে এখন আগের পদেই কাজ করতে হবে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অতিরিক্ত সচি শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘অতিরিক্ত সচিবের ১২১টি হলো রেগুলার পদ। আমাদের প্রকল্প আছে প্রায় এক হাজার। বড় বড় প্রকল্পের পরিচালকরা সবাই অতিরিক্ত সচিব।’

তিনি বলেন, ‘তাই অতিরিক্ত সচিবদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জন অতিরিক্ত থাকতে পারেন, যাদের পদায়ন করা যাবে না। আশা করি, এ ছাড়া অন্যদের পদায়ন করতে আমাদের সমস্যা হবে না।’ আরএমএম/জেডএ/পিআর