বিনোদন

গানে গানে স্মরণীয় আব্দুল জব্বার

বাংলাদেশের সংগীত যাদের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম একজন শিল্পী ছিলেন আব্দুল জব্বার। বাংলা গানের কিংবদন্তি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিপ্লবী কণ্ঠযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী ছিলেন তিনি। এক জীবনে প্রচুর জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে গেছেন। প্রিয়সব মানুষদের ছেড়ে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। রেখে গেছেন অনেক জনপ্রিয় গান। গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ ভূমিকাও পালন করেছেন।

Advertisement

তার গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’,‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়। আব্দুর জব্বারের সেরাগানগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে আরও একবার।

মুক্তিযুদ্ধের গানে জব্বারস্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অনেক গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন। তৎকালীন সময়ে কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘুরে হারমনি বাজিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন, যা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসঙ্গীত গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ টাকা তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জব্বারআব্দুল জব্বার স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও সংস্কৃতি আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি রেডিও বাংলাদেশের সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে সে চাকুরী ছেড়ে দেন এবং রসায়ন শিল্প সংস্থার উচ্চতর পদে চাকুরী গ্রহণ করেন। না এর পরও থেমে থাকেননি এই শিল্পী। দেশের সমৃদ্ধি ও সংকট সব সময়েই গান গেয়ে গেছেন। মানুষকে উজ্জিবিত করেছেন।

Advertisement

সিনেমার গানেপ্লেব্যাকেও সেরা ছিলেন আব্দুল জব্বার। তার জনপ্রিয় সিনেমার গানের তালিকা বেশ লম্বা। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সংগম’-এর গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে তার গাওয়া ‘তুমি কি দেখছো কভু, জীবনের পরাজয়’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ড. মোহাম্মদ মনিরুজামানের লেখা এ গানটির সুর করেছিলেন সত্য সাহা। ১৯৬৮ সালে ‘পিচ ঢালা পথ’ ছবিতে রবীন ঘোষের সুরে ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’ এবং ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে ‘সুচরিতা যেয়ো নাকো আর কিছুক্ষণ থাকো’ গানে কণ্ঠ দিয়ে নন্দিত হন। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটিও ছিল তুমুল জনপ্রিয়।

১৯৭৫ সালের ‘মাস্তান’ সিনেমায় ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে’ গানটিও শিল্পী আবদুল জব্বারের অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। আহমদ জামান চৌধুরীর রচনা ও আজাদ রহমানের সুরে এ গানটি আজও রয়েছে শ্রোতাদের প্রিয় গানের ‘বন্ধু তুমি শত্রু তুমি’ শিরোনামের একটি গান।

‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা’ আব্দুল জব্বারে দরাজ গলায় গাওয়া এ গানটি স্মরণীয় হয়ে আছে এর চমৎকার কথার জন্য। তার গাওয়া প্লেব্যাক গানের মধ্যে এ গানটির রয়েছে এক বিশেষ আবেদন। ‘মা’ গানটি ১৯৭৭ সালে সিনেমার জন্য গেয়েছিলেন তিনি। ‘তুমি আছো সবই আছে’ মিষ্টি প্রেমের এ গানটি শিল্পী আবদুল জব্বারের অন্যতম শ্রোতাপ্রিয় একটি গান। শাবানা-ফারুক অভিনীত ‘সখী তুমি কার’ সিনেমার জন্য গানটি গেয়েছিলেন তিনি। আজিজুর রহমানের সুর ও মুসলেহউদ্দিনের কথায় সিনেমার গান ‘তারা ভরা রাতে’ কিংবা ‘বেইমান’ সিনেমার ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই’ গানগুলোও তার সিনেমার উল্লেখযোগ্য গান।

বেতারের ও টেলিভিশনে জব্বারশিল্পী আব্দুল জব্বার ১৯৫৮ সাল থেকে বেতারে গান গাওয়া শুরু করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম গাওয়া হয় এ গানটি। ফজল-এ-খোদার রচনায় এ গানটির সুরারোপ করেন আব্দুল জব্বার। গানটি প্রথম গাওয়া হয় তারই কণ্ঠে।আবদুল জব্বারের অন্যতম সেরা এ গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেরণা জুগিয়েছে হাজারও বাঙালির মনে। বিটিভিতে অনেক গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি।

Advertisement

শেষ জীবনের গানের অ্যালবাম গণ জাগরণের গানই গেয়ে গেছেন আজীবন। গানের অ্যালবাম প্রকাশের কথা ভাবেননি সেই ভাবে। ২০১৭ সালে প্রকাশ হয় তার একটি মৌলিক গানের অ্যালবাম ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’। অ্যালবামটিতে ৯টি গান আছে। গানগুলো লিখেছেন মো. আমিরুল ইসলাম। সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন গোলাম সারোয়ার।

উল্লেখ্য, আবদুল জব্বার ১৯৩৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। সংগীতের তালিম নেন ওস্তাদ ওসমান গনি এবং ওস্তাদ লুৎফুল হকের কাছে। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

এমএবি/এলএ/জেআইএম