মতামত

বিজ্ঞানে তৃপ্তি, কাঁটা হয়ে থাকলো সেই ইংরেজি

সময়তো বরাবরই বদলায়। সেই সঙ্গে বাঙালির আবেগ-অনুভূতিও যে এভাবে বদলে যায় বা গেছে- বুঝতে পারিনি। শনিবার রাতেই মাথায় ছিলো রোববার প্রকাশ হবে এসইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল। সাংবাদিক হিসেবেতো বটেই, ব্যক্তি হিসেবেও বাড়তি একটা উত্তেজনা বোধ করেছি বরাবরের মতো। সেই যে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি এসএসসি কিংবা এইচএসসি`র ফল মানেই চারপাশে কেমন একটা উৎসবের আমেজ। কিন্তু সে ধরনের কোনো আমেজতো সোমবারের রাজধানীতে পেলাম না! ঘুম থেকে উঠেইতো ছুটেছিলাম অফিসে। মাথায় ওই এইচএসসি`র ফলটাকে সঙ্গে নিয়েই। কিন্তু অভিজ্ঞতা হলো ভিন্ন রকমের।সকালে প্রধানমন্ত্রীর হাতে যারা পরীক্ষার ফলের অনুলিপি দিতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যেই যা একটু উচ্ছ্বাস দেখলাম। কর্মব্যস্ততা ছিলো বোর্ডগুলোর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের মাঝে। আর উদ্বেগ-মেশানো একটা অজানা ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে কেবল শিক্ষার্থীরাই যা একটু হৈ-হুল্লোড় করলো। সেটা অবশ্য ছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আনন্দ-বেদনার অনুভূতি ছুঁয়েছে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক আর কিছু স্বজনের মাঝে। অথচ একটা সময় এসএসসি-এইচএসসির ফল প্রকাশের দিন পাড়া-প্রতিবেশি, কাছে-দূরে চেনা-অচেনা সবাইকে ভাবাতো। সেই দিনগুলো আর হয়তো খুঁজে ফেরা বোকামি।আবেগ থেকে  বেরিয়ে এবার বাস্তবতায় আসা যাক। এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৬৯.৬০%। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪২ হাজার ৮৯৪ জন। প্রথমেই আমাদের টেলিভিশনগুলোতে ব্রেকিং নিউজ ছাড়ার তোড়জোড়। পিছিয়ে থাকে না অনলাইনগুলোও। এটাইতো হওয়া কথা। প্রাথমিক কাজ সেরেই তুলনা করতে হয় গত বছরের ফলের সঙ্গে এবারেরটার। একটা চটকদার শিরোনামতো দিতে হবে! পেয়েও যাই। আরে এবারতো পাসের হার কমে গেছে ৮.৭৩ ভাগ! জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যাও কমেছে অনেকখানি! ২৭ হাজার ৭০৮ জন কম! ব্যস পেয়ে গেলাম ভালো একটা শিরোনাম। অনেকেরই হয়তো বদলে যায় শিরোনামের ভাষা। পাসের হার সরিয়ে প্রথম বাক্যেই হয়তো জায়গা করে নেয়, `এইচএসসিতে এবার কমেছে পাসের হার, কমেছে জিপিএ-পাঁচের সংখ্যা`। কোনো এক সহকর্মি যখন পরিসংখ্যানটা আরেকটু ভালো করে ঘেঁটে জানায়, এবারতো আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে এইচএসসি ও সমমানে- তখনতো বার্তা সম্পাদকদের পোয়াবারো অবস্থা। সংবাদ শিরোনাম হয়ে যায় আরো আক্রমণাত্মক।এতে যে খুব একটা দোষ আছে তা কিন্তু বলা যাবে না। কারণ যে দেশে ঋণাত্মক সংবাদে, আক্রমণাত্ম শিরোনামে টিআরপি বাড়ে, বাড়ে সার্কুলেশন- সেখানে আর কোনো উপায় হয়তো নেই। কিন্তু এটাওতো বাস্তবতা। ফল খারাপ হলে সেটাইতো তুলে ধরবে গণমাধ্যমগুলো। তাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো দায় এড়াতে পারে না কোনোভাবেই। আচ্ছা আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল কেন হলো এবার? তার ব্যাখ্যা কি শিক্ষাবোর্ডগুলো এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় দিয়েছে? অবশ্যই তাদের একটা পর্যবেক্ষণ আছে। কিন্তু তাদের সেই ব্যাখ্যা প্রকাশের প্রায় আড়াই ঘণ্টা আগেতো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।কি বলেছেন সরকারপ্রধান? স্পষ্টই তিনি বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত নাশকতাসহ আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড না চালালে এইচএসসিতে পাসের হার আরও বেশি হতো। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত মানুষ পুড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ওই অবস্থায় পরীক্ষা হয়েছে। এই কথায় অকাট্য যুক্তি আছে। ওই পরিস্থিতির মধ্যেও পড়ালেখা করে কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করায় শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। এই অভিনন্দনটা শিক্ষার্থীদের প্রাপ্যই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি সবটা বলেছেন? নাকি ফল বিপর্যয়ের পেছনে তিনি আর কোনো কারণ খুঁজে পাননি? বিরোধী জোটের নাশকতামূলক কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু ফল বিপর্যয়ে সেটিই একমাত্র কারণ হতে পারে না।বরং কিছুটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। যদিও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। অবশ্য তিনিও বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের কারণে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকের ফল সার্বিকভাবে ভালো হয়নি। এই দেশে আসলে রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, শিক্ষা থেকে সমাজব্যবস্থা- সবকিছুতেই যখন নেতিবাচক কিছু ঘটে অবধারিতভাবেই তার একটা দায় চাপানো হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর। সবকিছুতেই রাজনৈতিক বক্তব্য এবং ব্যাখ্যা দেয়াটা আমাদের নেতাদের একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই মূল কারণগুলো থেকে চোখ সরে যায় প্রথম পর্যায়েই। এবার আসা যাক শিক্ষামন্ত্রীর তত্ত্বীয় ব্যাখ্যায়। সেটা অবশ্য ঠিক ব্যাখ্যা নয়। পর্যালোচনা কিংবা মূল্যায়ণ বলা ভালো। সার্বিক ফল ভালো না হলেও বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, এবার বিজ্ঞান ও অংকে ভালো করেছে শিক্ষার্থীরা। এটা ভালো খবর। কারণ প্রযুক্তির এই যুগে বিজ্ঞান এবং অংকে ভালো না করলে পিছিয়ে পড়তে হবে বাকি দুনিয়া থেকে। আর সব সময়তো একটা আক্ষেপ ছিলোই- আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ছে। সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।বিজ্ঞানের পাশাপাশি উন্নতি হয়েছে কারিগরিতেও। বেড়েছে পাসের হার। সরকার অবশ্য কারিগরি শিক্ষার দিকে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। মোট শিক্ষার্থীর ৯ শতাংশ এখন কারিগরি বোর্ডের। ২০২১ সালের মধ্যে এই ২০ শতাংশে নেয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের।  কিন্তু কারিগরি শিক্ষার মান কি বেড়েছে আগের চেয়ে? বাড়লে সেটা কতটা সন্তোষজনক? শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষার্থীরাও বাড়তি পর্যবেক্ষণে থাকায় ফল ভালো হয়েছে। সাধারণ শিক্ষাবোর্ডগুলোর তুলনায় তা অনেক ভালোই। ৮৫.৫৮ শতাংশ পাস করলে তাকে ভালো না বলে উপায় নেই। কিন্তু কি ধরনের কারিকুলাম তাদের পড়ানো হচ্ছে? কি ধরনের প্রশ্নপত্র তৈরি করা হচ্ছে? এগুলো ভেবে দেখতে হবে বৈকি। কারণ শুধু পাস করানোর জন্য যদি কারিকুলাম হয়ে থাকে- তাতে কেবল অদক্ষ জনশক্তিই তৈরি হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে যে ধরনের কারিগরি শিক্ষা দরকার- তার কতটা নিশ্চিত হয়েছে?ফল বিপর্যয়ে এবার সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে যশোর শিক্ষাবোর্ড। এই বোর্ডে এবার পাসের চেয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ঢের বেশি। যশোরে মোটা পাসের হার ৪৬.৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ একটি শিক্ষাবোর্ডের ৫৩.৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছে। সত্যিকারের ফল বিপর্যয় আসলে যশোর বোর্ডেই হয়েছে। এই বোর্ডে নাকি একক বিষয় হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে ইংরেজিতে। এ বিষয়ে মোট পরীক্ষার্থীর ৫১ শতাংশ পাস করেছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক পরীক্ষার্থীই ফেল করেছে ইংরেজিতে। অন্য বিষয়গুলো নিয়ে তাই আপাতত আলোচনা না করলেও চলবে। গণমাধ্যমে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল মজিদের একটি বক্তব্য এসেছে। তিনি বলেছেন, ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র এবার খুবই কঠিন হয়েছিলো। তারই প্রতিফলন পরীক্ষার ফলে। কিন্তু যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, প্রশ্নপত্র `সহজ` এবং `কঠিন`- এই দুই শ্রেণিতে কেন ফেলছেন? আমাদের ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা যদি সঠিক এবং কার্যকর হতো তাহলেতো `কঠিন` শব্দটি ব্যবহার করার প্রশ্নই আসতো না। এটাতো সবারই জানা, এই দেশের শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে ১২ বছর ইংরেজি পড়েও ইংরেজিটা শিখতে পারে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পরও দেখেছি অনেকে সাধারণ ইংরেজি বাক্যগুলোও সঠিকভাবে বলতে কিংবা লিখতে পারে না। ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি না থাকলে এমনটা হওয়ার কথা নয়।কেবল বিজ্ঞান কিংবা অংকে হঠাৎ করে ভালো করার খবরে খুশি হওয়া যেতে পারে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কিছু নাই। কারণ বদলে যাওয়া সময়ে, বদলে যাওয়া বিশ্বব্যবস্থায় বদলে গেছে অনেক কিছুই। বাংলাদেশের কোনো এক পাড়াগাঁয়ের কোনো এক শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেকোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গেই। কারণ এটাই বিশ্বায়ন। কারণ রাজনীতি, অর্থনীতি, পদার্থ, রসায়ন, সমাজবিজ্ঞান- যাই বলি না কেন প্রতিযোগিতা এখন বিশ্বময়। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও গড়ে তুলতে হবে সেভাবেই। বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে তাদের জন্য। শিক্ষার্থীদের তাই ভালো করতে হবে সব বিষয়েই। কোনো একটি বা দু`টি বিষয়ে ভালো করলেই চলবে না। সেক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থা এবং কারিকুলাম সাজাতে হবে সেভাবেই।লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভিshahariar@journalist.comএইচআর/এমএস

Advertisement