চামড়া খাতের কোম্পানি ক্রিসেন্ট লেদারের রফতানির টাকা দেশে আসেনি। অথচ নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে একের পর এক বিল কিনেছে জনতা ব্যাংক। এই কায়দায় জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা তুলেছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ ঘটনায় জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার ৮ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও শাখার বৈদেশিক ব্যবসার লাইসেন্স (এডি লাইসেন্স) স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অধিকতর তদন্তও হয়েছে। তবে তদন্তে পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া।
Advertisement
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এ কেলেঙ্কারির বড় অংশই হয়েছে রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে জনতা ব্যাংকের খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ। আর রিমেক্সের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আবদুল আজিজ, যিনি জাজ মাল্টিমিডিয়ারও কর্ণধার।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজের বড় ভাই এমএ কাদের। তিনি ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, ক্রিসেন্ট ফুটওয়্যার, রূপালী কম্পোজিট লেদার, লেক্সকো লিমিটেড ও গ্লোরি এগ্রোর কর্ণধার। সব প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলা হয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপের নামে। গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে রয়েছেন এমএ কাদের। আর রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এমএ আজিজ।
চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসায় এই দুই ভাই এমএ কাদের ও এমএ আজিজ ২০১৩ সাল-পরবর্তী পাঁচ বছরে জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। এর মধ্যে পণ্য রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা তহবিল থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বর্তমানে ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে জনতা ব্যাংকের। এর বাইরে পণ্য রফতানির ১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকাও আটকে গেছে।
Advertisement
জাজের ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়ে জানতে জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে বেশ কিছু গণমাধ্যমে তিনি দাবি করেন, রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান এমএ আজিজ তিনি নন। ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদেরকেও তিনি চেনেন না।
তবে কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান এমএ আজিজই জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) সূত্রেও এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। আব্দুল আজিজ ও তার বড় ভাই এম এ কাদের চামড়াজাত পণ্যের এই ব্যবসা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন।
দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে জাজ মাল্টিমিডিয়ার আবির্ভাব ২০১১ সালে। এরপর একের পর এক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি। নবাব, শিকারি ও অগ্নি এর মধ্যে অন্যতম। এর বাইরে বস ২, পোড়ামন ২, বাদশা-দ্য ডনের মতো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছে তারা। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও বিনিয়োগ করেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। মাহি, নুসরাত ফারিয়ার মতো নায়িকার উত্থান এ প্রতিষ্ঠানের হাতেই। শাকিব খানের ব্যবসাসফল অনেক চলচ্চিত্রও জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে।
জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর্দার আড়ালের প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাই জাজ মাল্টিমিডিয়াকে দেখছেন ব্যাংকাররা। জনতা ব্যাংক সূত্রমতে, ব্যাংকটি থেকে বের করে নেয়া এ ঋণই জাজ মাল্টিমিডিয়ার অর্থের মূল উৎস। জনতা ব্যাংক থেকে অবাধে ঋণপ্রাপ্তির সময় থেকেই জাজ মাল্টিমিডিয়ার উত্থান। রিমেক্স ফুটওয়্যার নামে একটি অখ্যাত চামড়াজাত পণ্যের কোম্পানির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে এ অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে।
Advertisement
রিমেক্স ফুটওয়্যারের দায়-দেনার একটি হিসাব উল্লেখ করে তা পরিশোধের জন্য আব্দুল আজিজকে চিঠি দিয়েছে জনতা ব্যাংক। সেখানে দেখা যায়, গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে রফতানি বিল ক্রয় (এফডিবিপি) বাবদ জনতা ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৫৩৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৯০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি প্যাকিং ক্রেডিট (পিসি) বাবদ ১৬৬ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৪৫৭ টাকা ঋণ নিয়েছে। সাধারণত রফতানি পণ্য শিপমেন্টের জন্য এ ধরনের ঋণ দেয়া হয়। রিমেক্স ফুটওয়্যার রফতানির জন্য অগ্রিম ক্যাশ সাবসিডি হিসেবে নিয়েছে ১৪ কোটি ৮৩ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪২ টাকা।
এছাড়া রফতানি বিল প্রত্যাবাসন না হওয়ায় প্রায় ১০৪ কোটি টাকা ফোর্সড লোন সৃষ্টি হয়েছে। রিমেক্স ফুটওয়্যারের অন্য দায়গুলো হলো— সিসি হাইপো ৯৪ কোটি ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭০ টাকা, সিসি প্লেজ ১০৮ কোটি ৯০ লাখ ৭ হাজার ৮৬৪ টাকা, আইএফডিবিসি ৭১ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং এলসি বাবদ ১ কোটি ৩২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ৬২৩ টাকা।
এমএ আজিজকে দেয়া চিঠিতে ব্যাংকের সব দায় পরিশোধের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। জনতা ব্যাংক এমডি এ প্রসঙ্গে বলেন, রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এমএ আজিজকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি ব্যাংকের পাওনা টাকা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরত দেবেন বলে প্রত্যাশা করছি। নইলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এআর/এলএ/এমএস