একটা ঐক্য প্রক্রিয়ার কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাচ্ছি। যাকে জাতীয় ঐক্য বলা হচ্ছে। কিন্তু সোজা সাপ্টা এবং সরল করে বললে, এই ঐক্য আসলে আওয়ামী-বিরোধী জাতীয় ঐক্য। কারণ, শুধু জাতীয় ঐক্যের বিষয় হলে সেখানে আওয়ামী লীগের মতো পুরনো এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক দলেরও অংশগ্রহণ থাকার কথা।
Advertisement
সেটিতো হচ্ছে না, যদিও গণফোরামের এক নেতা বলেছেন যে, তারা আওয়ামী লীগকেও আহ্বান জানাবেন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে, এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনো আহ্বান বা সংবাদ চোখে পড়েনি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যারা যারা থাকছেন তাদের বেশিরভাগই এক সময়কার আওয়ামী লীগার এবং এখন দলছুট বা বলা ভালো তারা আসলে দলের সঙ্গে, দলের নেতৃত্বের সঙ্গে ‘বিট্রে’ করেই এখন একেকজন একেক জায়গায় গিয়ে থিতু হয়েছেন এবং এখনও তারা সমান ভাবেই আওয়ামী-বিরোধিতা নিয়েই আছেন।
ফলে বর্তমান আওয়ামী লীগকে এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় আহ্বান জানানোর অর্থই হচ্ছে যারা এই ঐক্য প্রক্রিয়ায়র সঙ্গে এই মুহূর্তে যুক্ত এবং এক সময়কার আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের বর্তমান আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়াই- সেটিতো হবার নয় বলেই মনে হচ্ছে, এবং সে কারণেই এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের যুক্ত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
তার মানে এই সত্যকে সামনে রেখেই আমাদের এগুতে হবে যে, কথিত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া আসলে একটি আওয়ামী-বিরোধী ঐক্যমঞ্চ বা শেখ হাসিনা-বিরোধী ঐক্য। এমন সম্ভাবনাকেও আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না যে, ১/১১ বা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতির মতো কোনো পরিস্থিতি এলে, এই শেখ হাসিনা-বিরোধী ঐক্যমঞ্চে আমরা এই মুহূর্তে যারা আওয়ামী লীগ নামক দলটিকে আলো করে আছেন তাদেরও অনেককে দেখতে পারি। কিন্তু সেরকম পরিস্থিতি ঘটার মতো সুযোগ আর এদেশে আছে কি-না সেটা নিয়ে অন্য কোনো সময় আলোচনা হতেই পারে।
Advertisement
কিন্তু যে প্রশ্নটি নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই আজ তাহলো, এই আওয়ামী-বিরোধী জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এমন কী এই দেশ ও জাতিকে দিতে পারবে যা আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা দিতে পারছেন না? এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপি যুক্ত হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং আমরা এটাই ধরে নেই যে, বিএনপি-ই এর নেতৃত্বে থাকবে। কারণ বেগম জিয়া বা তারেক জিয়া কেউই তাদের নেতৃত্বের জায়গাটি ড. কামাল হোসেন. ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী বা আসম আব্দুর রবকে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত হবে না।
আর জেনারেল জিয়া পরিবারের দুই সদস্য ছাড়া বাকি যাদের নামোল্লেখ করা হলো তাদের কারোরই নিজেদের নেতৃত্ব তাদের ওপর প্রতিষ্ঠার শক্তি বা সামর্থ কোনোটিই আছে বলে এদেশের একটি পত্র-পল্লবও মনে করে না। আর বাংলাদেশকে ঘিরে বিদেশিদের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের বিষয়টি এতোটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে, তারা নতুন করে একজন ড. ইউনূসের ওপর আর বাজি ধরতে যাবেন বলেও প্রমাণ মেলে না।
এমতাবস্থায় সেই বিএনপি-ই ভরসা। কিন্তু বিএনপি-তো নিজেই তাদের কপাল বর্গা দিয়ে বসে আছে জামায়াতে ইসলামীর কাছে। আবার জামায়াত ইসলামীও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কার্যকর শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এমন এক চাপে রয়েছে যে, তারা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতেই সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। তাদের নিবন্ধন পর্যন্ত নেই। আর অর্থনৈতিক শক্তি ইসলামী ব্যাংক হাতছাড়া হওয়ার পর থেকেই পড়তির দিকেই। এমতাবস্থায়, যতোটুকু যা সাংগঠনিক শক্তি তা কেবল বিএনপি’রই আছে আর সেই সঙ্গে যদি জামায়াতের সহিংস রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করি তাহলে এই কথিত ঐক্যের মূল আসনেও বিএনপি-জামায়াতকেই দেখা যায়। আর বাকি সবাই এদের পক্ষে দোহার।
কিন্তু আমরা যদি ২০০১ থেকে শুরু করে ১/১১ পর্যন্ত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই যে, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো দেশে একটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করা সত্ত্বেও নির্বাচনের মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভয়ঙ্কর এক রক্তাক্ত আক্রমণের শিকার হয়ে প্রায় দেশছাড়া হতে শুরু করেছিল। আওয়ামী লীগকে এলাকা বা দেশ-ছাড়া করে সেই জায়গাটি ভরার সুযোগটি যদি বিএনপি বা ছাত্রদলও নিতো তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। সেই জায়গাটি দখল করেছে জামায়াত, বাংলা ভাই এবং হরকত-উল-জিহাদ আল ইসলামীর’র মতো সন্ত্রাসী শক্তি।
Advertisement
সাধারণ বাঙালি এই শক্তিকে কেবল ভয়-ই পেয়েছে তা নয়, তারা মনে করেছে যে, বাংলাদেশকে তো আফগানিস্তান বা পাকিস্তান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং যে কোনো মুহূর্তে এই অজুহাতে বাংলাদেশে আকাশ থেকে বোমা পড়তে শুরু করবে- ফলে বাঙালি প্রতিবাদমুখর হয়েছে। আওয়ামী লীগকেই তারা একমাত্র ত্রাতা হিসেবে তখন পাশে পেয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াত যখন এক লাইনে, একই ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে আর দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ কখনও ভয়ে বা কখনও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়া হবে ভেবে চুপ করে গিয়েছে তখন আওয়ামী লীগ এর প্রতিবাদে দেশে ও বিদেশে যুগপৎ প্রতিরোধ তৈরি করেছে এবং তার ফলে বাংলাদেশ আসলে সেই সময় এই জঙ্গীবাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সেই সময় বাঙালিকে এই ভীতি থেকে বের করার জন্যই অ-রাজনৈতিক সরকার গঠনের সিদ্ধান্তে দেশি-বিদেশি ‘সুশীল শক্তি’ এগুতে পেরেছিল, কারণ তারা জানতো যে, বাঙালি তার প্রাণের রাষ্ট্রটিকে আফগানিস্তান বা সোমালিয়া হতে দিতে চায় না।
তার মানে কী দাঁড়ালো? তার মানে হচ্ছে, ২০০৬ সালের শেষের দিকেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি অনাকাঙ্খিত, অপাংতেয় এবং এর পক্ষে আসলে জনমত নেই। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকগোষ্ঠী বা ভোটাররাও এটা মনে করেছে যে, একদিকে জঙ্গিবাদকে উত্থানের সুযোগ দিয়ে, হাওয়া ভবনকে দিয়ে লুটপাট করিয়ে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি’কে আসলে একেবারেই দুর্বল একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত করা হয়েছে, যাদের হাতে মেয়াদ শেষে নির্বাচনী প্রচারের জন্য উদ্বোধন করার মতোও কোনো স্থাপনা নেই।
অপরদিকে, জামায়াত কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই অর্থনৈতিক ভাবে আরো সুসংহত হওয়ার দিকটিতে জোর দেয় এবং তাতে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। এখনও পর্যন্ত জামায়াত সেই অর্থের বলেই টিকে আছে। নাহলে বিদেশি বিশেষ করে পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে জামায়াতের জন্য অর্থের সমাগম অনেকটাই কমে গেছে।
অপরদিকে ১/১১-র আমলে অ-রাজনৈতিক সুশীলদের রাজনীতির আকাঙ্খা উদগ্র হয়ে ওঠায় এবং সেই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে গিয়ে তারা যে সেনা বাহিনীর ঘাড়ে সওয়ার হতেও দ্বিধা করেন না সেটাও প্রমাণিত হওয়ায়, জনগণের যে অংশটি তাদেরকে সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাদেরও মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। এই মোহভঙ্গ বাঙালির জন্য প্রয়োজন ছিল খুউব।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা বিএনপি-জামায়াত বা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি বা অপশাসন নিয়ে কথা বলি, প্রতিবেদন প্রকাশ করি কিন্তু ১/১১ সরকারের দুই বছরে হওয়া দুর্নীতি, অপশাসন এবং কুর্কীতি নিয়ে কোনো কথা কেউ বলি না। কারণ, তাতে বহুবিধ ভীতির কারণ রয়েছে। কিন্তু তারপরও ১/১১ সরকার আমাদেরকে এটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এদেশের সুশীল সমাজ বলে খ্যাত অরাজনৈতিক গোষ্ঠীটিও আসলে কতোটা রাজনৈতিক এবং তাদেরও রয়েছে লোভ, ক্ষমতা এবং দুর্নীতির প্রতি দুনির্বার আকর্ষণ।
আওয়ামী লীগের দশ বছরের শাসনকাল নিয়ে বলার মতো কথা অনেক আছে এবং এই সময়টা দেশে উন্নতি যতোটা হয়েছে সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি এবং অপরাজনীতিও যে হয়নি সেকথা বলার মতো সৎ সাহস হয়তো একেবারে পাঁড় আওয়ামী লীগার কারোরও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই যে বিএনপি-জামায়াত এবং ১/১১-র শাসকালে যাদের শাসন-দুঃশাসহন-অপশাসনের মুখোশ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে তাদের তুলনায় আওয়ামী লীগের দশ বছর কোন্ দিক দিয়ে খারাপ- সে প্রশ্ন তোলার সময় এখন এসেছে।
খুব বড় কোনো গবেষণা ছাড়াই আমরা একথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, বিগত দশ বছর তার আগের আট বছরের তুলনায় কোনো ভাবেই খারাপ ছিল না, বরং বলা যায় যে, সর্বার্থেই এই দশ বছর তুলনামূলক ভালো ছিল। অবশ্যই এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। কিন্তু মোটা দাগে এই তুলনা থেকে এই উপসংহারে পৌঁছা যায় যে, যে কথিত আওয়ামী-বিরোধী জাতীয় ঐক্যের গল্প আমরা শুনছি এবং তার পেছনে যারা রয়েছেন তারা আসলে এমন কিছুই দিতে পারবেন না আমাদের যা বিগত দশ বছরে আওয়ামী লীগ আমাদের দেয়নি। তাহলে সেই প্রশ্নেরও সুযোগ তৈরি হয় যে, তাহলে এরকম কোনো ঐক্যকে কেন বাঙালি সমর্থন দেবে?
কেবলমাত্র বিকল্পের জন্য বিকল্প? বাঙালি কি এখনও সেরকম বোকা আছে আর? আরো বড় কথা হলো, এই ঐক্যতলে এখন যারা অবস্থান নিতে যাচ্ছেন তারা কারা? বেগম জিয়া যদি তার নেত্রী হন তাহলে তিনি এখন দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তার পুত্র তারেক জিয়া আরেক ডিগ্রি সরেস, একজন পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আসামি- তাদের সঙ্গে যে সুশীল চেহারা যুক্ত হতে যাচ্ছেন তারা যে দেশের প্রতি ‘লয়্যাল’ নন, সেটা ১/১১ আমাদের জানিয়েছে। রইলো বাকি জামায়াত- বলা হচ্ছে জামায়াত এই ঐক্যে নেই, কিন্তু তারা বিএনপি’র সঙ্গে আছে- মানে কী দাঁড়ালো?
মাছের ঝোল খাবো কিন্তু মাছ খাবো না কিংবা মিনসের সঙ্গে ঘর করবো কিন্তু হেঁসেলে ঢুকতে দেবো না- বাঙালি এই শুভঙ্করের ফাঁক ধরতে পারবে না বলে ভাবলে ২০১৮ সালে আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা আরো বড় একটি ভুলই করবেন বটে।
ঢাকা ২৮ আগস্ট, মঙ্গলবার ২০১৮সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর