>> বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন দিয়ে ইউজিসি গঠন করেছিলেন>> উচ্চশিক্ষা কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই থাকছে>> সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ক্ষমতা না বাড়লেও এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন করে ‘স্বশাসন’ দেয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই নখ-দন্তহীন এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ‘উচ্চশিক্ষা কমিশনে’ রূপান্তর করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
উচ্চশিক্ষা কমিশন আইনের সর্বশেষ খসড়া পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেই কাজ করবে। কমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্য ও সচিবের পদমর্যাদা সরকারই নির্ধারণ করবে। সরকারের অনুমোদনক্রমে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
ইউজিসির তৈরি খসড়ায় বলা হয়েছিল, কমিশন হবে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীন। স্বাধীনভাবে এই কমিশন যে কোনো প্রশাসনিক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কমিশনের চেয়ারম্যান একজন পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন, পাঁচ সদস্য প্রতিমন্ত্রীর এবং কমিশনের সচিব সরকারের সচিবের মর্যাদা পাবেন। কিন্তু সচিব কমিটির বৈঠকে এসব বিষয়ে কাটছাঁট করা হয়েছে।
Advertisement
আরও পড়ুন >> দারুল ইহসানের সার্টিফিকেটের বৈধতা দিতে রাজি নয় ইউজিসি
দেখা গেছে, প্রস্তাবিত আইনে পাঠক্রমের মানোন্নয়নের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উদ্ভাবন এবং গবেষণাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ আইনের আলোকে শিক্ষকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব চ্যান্সেলরের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন। কমিশন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে এবং এর স্থায়ী ধারাবাহিকতা থাকবে।
কমিশন মামলা করতে পারবে বা কমিশনের বিরুদ্ধেও মামলা করা যাবে। আইন জারি হওয়া মাত্র ‘ইউজিসি’ বিলুপ্ত হয়ে ‘বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন’ নামে প্রতিষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেবেন। এতে আরও বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান ছাড়াও একজন পূর্ণকালীন সদস্যসহ রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে আরও পাঁচজন পূর্ণকালীন সদস্য ও একজন খণ্ডকালীন সদস্যসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিকল্পনা বিভাগের একজন সদস্য এবং অর্থ বিভাগের সচিবকে কমিশনের সদস্য করা হয়েছে। কমিশনে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তিনজন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তিনজন উপাচার্যসহ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তিনজন ডিনকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে সদস্য করা হবে।
Advertisement
কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক বা প্রশাসক হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে খ্যাতিমান ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে অন্যূন ২০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে- এমন ব্যক্তি বা শিক্ষাবিদকে কমিশনের পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে।
চেয়ারম্যান ও পূর্ণকালীন সদস্য চার বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন। তবে তারা দ্বিতীয় মেয়াদেও নিয়োগ পেতে পারেন।
সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী স্থায়ী সনদপ্রাপ্ত) ছয় সদস্য (উপাচার্য) এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন সদস্য হিসেবে মনোনীত তিনজন ডিন দুই বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন। চেয়ারম্যান হবেন কমিশনের প্রধান নির্বাহী। সরকার কমিশনের সচিবকে নিয়োগ দেবে। সচিবালয় থাকবে কমিশনের চেয়ারম্যানের অধীন। সচিবালয়ের সচিব কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন বিভাগের প্রধান হবেন। অন্যান্য বিভাগীয় প্রধানদের পদবি হবে ‘পরিচালক’। আইনে বছরে কমপক্ষে তিনটি সভার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, কমিশন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা দিতে পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতির আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নেবে। এজন্য আন্তর্জাতিক রেটিংপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোর্স-কারিকুলাম প্রণয়ন, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রেডিট ট্রান্সফার এবং ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক বিনিময় কর্মসূচি নেয়া হবে। কমিশন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা কার্যক্রমের তদারকি, মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার চাহিদা নিরূপণ, পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বিভিন্ন নীতিমালা প্রস্তুত করবে। এ আইনের অধীন কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন, উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় বাজেট গ্রহণ করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা কমিশনের জন্য সরকারের কাছে আমরা নতুন কিছু চাইনি। অন্য ১০টি দেশে যেভাবে উচ্চশিক্ষা কমিশন রয়েছে ঠিক সেভাবেই আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার যদি এসব না ভেবে শুধু অন্যান্য অধিদফতরের মতো উচ্চশিক্ষা কমিশন করে দেয় তাতে খুব একটা লাভ হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু নাম পরিবর্তনের জন্য ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশন করতে চাইনি। আমরা নির্বাহী ক্ষমতাসহ স্বশাসন বাড়াতে চেয়েছি।’ নাম পরিবর্তন কিংবা কাঠামোগত চরিত্র পরিবর্তন কাম্য নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘নানা বিশ্লেষণের পর উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের জন্য প্রণীত আইনটি সচিব কমিটির অনুমোদন পেয়েছে। এখন মন্ত্রিসভায় যাবে। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে আইনটি উত্থাপনের জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’
ইউজিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, কমিশন যে খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল তা সংশোধন করে ১৩টি স্থানে ‘সরকারের অনুমোদনক্রমে’ বাক্যাংশ যোগ করা হয়েছে। ফলে কমিশনের যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। এখন ইউজিসি নিজস্ব পদ সৃষ্টি, যোগ্যতা নির্ধারণ ও নিয়োগ- সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু কমিশন গঠনের পর সে ক্ষমতাও থাকবে না। সিলেবাস কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ও তাদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেই আইনে চলেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে স্পিরিট নিয়ে আইনটি তৈরি করেছিলেন সময়ের তাগিদে সেটি আপডেট হলেও আশা করছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার স্পিরিট ধরেই আইনটি সংসদে পাস হওয়ার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করবেন।’ ২০১২ সালের ৩ মে প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন, উৎকর্ষসাধন এবং বিস্তৃতির লক্ষ্যে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন-২০১২-এর খসড়ার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের মন্তব্যসহ মতামত দেয় ইউজিসি।
২০১৩ সালের ১০ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। নীতিগত অনুমোদনের জন্য খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপিত হলে সেটি ফিরিয়ে দিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর নানা প্রক্রিয়া শেষে ফের সচিব কমিটিতে তোলা হলে আইনটি অনুমোদন পায়। এখন এটি আবারও মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে যাবার অপেক্ষায় রয়েছে।
এমএইচএম/এসআর/এমএআর/আরআইপি