মতামত

ত্যাগের পূণ্য ভোগে হাসিল?

ত্যাগ, বিসর্জন, দান, উৎসর্গসহ কিতাবে যতো কথাই থাক, বাস্তবে ভোগের কোনো কমতি হয়নি ঈদে। হতে পারে সামনে নির্বাচনসহ বিভিন্ন কারণে এবার এ মাত্রা তুলনামূলক বেশি। এরপরও সাম্য, সম্প্রীতি, ত্যাগ, উৎসর্গের জয়গানই করতে হয়। রাখতে হয় বিশ্বাসও।

Advertisement

কোরবানির ধর্মীয় অর্থ ব্যাপক। গুরুত্ব বিস্তর। এর আভিধানিক অর্থের মধ্যে রয়েছে- উৎসর্গ, ত্যাগ, বিসর্জন, উপঢৌকন, সান্নিধ্য ইত্যাদি। কোরবানি নিছক পশু জবাই-ও নয়। তা অনেকটাই প্রতীকী। হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক হজরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানিই ইসলামে বা দুনিয়াতে প্রথম কোরবানির ঘটনা নয়।

কোরবানি প্রথার তথ্য পাওয়া যায় প্রথম নবী ও প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর সময়ও। আদম (আ.) এর নির্দেশে হাবিল-কাবিলের কোরবানি দেওয়ার ঘটনার তথ্য পবিত্র কোরআনেও রয়েছে। যে কাহিনী রয়েছে সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে। তারপর আল্লাহর নবী হজরত নূহ (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.) ও হজরত মুসা (আ.)-এর সময়ও কোরবানির প্রচলন ছিল।

মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ-প্রেমে স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাসের জন্ম দেন। পবিত্র তাকওয়ার সেই স্মৃতিকে চির জাগরূক রাখতে নবম হিজরি সালে কোরবানির ওহি নাজিল হয়। এই একই সময়ে হজের নির্দেশও নাজিল হয়।

Advertisement

হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোরবানিকে উল্লেখ করেছেন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত হিসেবে। হজরত মুসা (আ.)-এর সময়েও কোরবানি প্রথার কথা রয়েছে আল কোরআনে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ইবরাহিমের সুন্নত হিসেবে তাঁর উম্মতের জন্য কোরবানির প্রচলন করেন।

অর্থাৎ প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আ.) থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর উম্মতের জন্যই কোরবানির হুকুম রয়েছে। আরবি কুরব শব্দ থেকে কোরবানি উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভ।

কোরবানির মাধ্যমে কিভাবে তাঁর নৈকট্য লাভ করা যায় সেই নির্দেশনা, পদ্ধতি সবই কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। আলেম-ওলামারাও সেই শরিয়তি পরিভাষার বয়ান, বর্ণনা দিয়ে আসছেন। কোরবানি দেয়ার সামর্থ্য নেই- এমন ব্যক্তির দুই রাকায়াত ঈদের নামাজ পবিত্র নিয়তে আদায় করলে তারও তাকওয়া অর্জিত হয়ে যাবে।

পরিবার-পরিজনের মন খারাপের ভয়ে কিংবা সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে কেউ কোরবানি দিলে তাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন না। এ রকম স্পষ্টতার পরও ত্যাগের জানান দেওয়া পরীক্ষার পর্যায়ে পড়ে না।

Advertisement

কালের স্রোতে প্রতি বছর পবিত্র হজের পরে ঈদুল আজহা। এ কোরবানিকে ঘিরে চলে ধুমধামের সঙ্গে মনের পশুপ্রবৃত্তি ত্যাগের মহোৎসব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়।

ধর্মীয় বিভিন্ন বর্ণনা, নির্দেশনায় মুসলমানদের বিশ্বাস, কোরবানি করা পশুর গোশত আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না, পৌঁছায় বান্দার ত্যাগের মানসিকতার প্রমাণ। নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোরবানির অন্তর্নিহিত এ শিক্ষা সুদূরপ্রসারীভাবে মানবকল্যাণের স্মারক। কিন্তু কোরবানি বা পশু জবাইর বাস্তব নমুনা ও চর্চা এ নির্দেশনার সঙ্গে কতোটা সামঞ্জস্যসই?

আল্লাহর নামে কোরবানি দিয়ে নিজের নাম জাহিরের ব্যাধি চারদিকে ভয়াবহ পর্যায়ে। এবার তা আরেকটু মাত্রা ছাড়ানো। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এটাই শেষ কোরবানি। সামর্থবানরা, বিশেষ করে রাজনীতির মানুষেরা একে নিয়েছেন লাস্ট চান্সের মতো। ত্যাগের বাহানায় ভোগ, প্রচার-প্রসারের মওকা হিসেবে।

সম্ভাব্য কিছু প্রার্থী কোরবানির নামে এলাকা মাত করে দিয়েছেন। হিম্মতের বিজ্ঞাপন করেছেন। বড় বড় গরু, মহিষ, গণ্ডার জবাইকে নির্বাচনী আবহে যোগ করেছেন তারা। দামি-দামি বিভিন্ন জাত, কাটিংয়ের গর্জিয়াস গরুর সঙ্গে নিজে এবং কর্মীরা সেলফি তুলে দুনিয়াবি সুখ আর ভোগে হেলান দিয়েছেন।

ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে মহিমান্বিত এই ঈদকে এভাবে প্রচার-প্রচারণার আইটেম করা ত্যাগের শিক্ষার সঙ্গে তামাশা কি-না , তার চূড়ান্ত বিচারের ভার স্বয়ং বিশ্বভ্রমাণ্ডের মালিকের। নালায়েক বান্দা হিসেবে বিবেচক মানুষ মাত্রই এতে ব্যথিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভোটের আগে আরেকটা ঈদ থাকায় গত ঈদে এই বাতিক এমন পর্যায়ে আসেনি।

এবার আখেরি চান্সের মতো নিজ নিজ এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে এ বিলাসে নেমেছেন দু’দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরাই। এবার আর্থিক অনুদান এবং উপহারও বিতরণ করছেন বেশি। তাদের নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসীর ভূরিভোজ করানোর কিছু খবর রীতিমতো হাস্যকর পর্যায়ে। অর্থ-বিত্ত, প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে ক্ষমতাসীনরা এ রেসে এগিয়ে। বিরোধীমতের নেতারা তুলনামূলক পিছিয়ে থাকলেও ত্যাগের নেকি ভোগে হাছিলের চেষ্টায় সাধ্য মতো কমতি করেননি।

প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে এবারের ঈদে প্রবাসীর আগমন রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ত্যাগে-ভোগে তাদের অনেকে ভোটপ্রার্থী। সিলেটে প্রবাসীদের এ আগমন মূলত এবার তুলনামূলক আগেভাগে শুরু হয়। তা সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগেই। তখন এলাকায় এসে তারা আর ফিরে যাননি। মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের সবার পক্ষেই মাঠে কাজ করেছেন কিছু প্রবাসী। দিয়েছেন অর্থ সহায়তাও।

কেউ কেউ সঙ্গে পরিবারের সদস্যসহ স্বজনদেরও এনেছেন। দিনকে দিন সিলেট অঞ্চলের বেশ কিছু প্রবাসী এখন আর অন্যের জন্য ত্যাগে না গিয়ে নিজেই ভোগের সারিতে। আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন দল থেকে প্রার্থী হতে চান তারা। সিটি নির্বাচনে মাঠে ঘোরাফেরার মধ্য দিয়ে তারা দল ও ভোটারদের কাছে নিজেদের জানান দিয়েছেন। সংখ্যায় তারা প্রায় ডজনের মতো।

রাজনীতির বাইরে সমাজের সামর্থবানরাও ত্যাগ, বিসর্জনের এই প্রতীকী মৌসুমে সাধ্যের জানান কম দেননি। ঈদের পরিবার পরিজনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারে আনন্দঘন ছবির পাশাপাশি অনেকেই প্রকাশ করছেন কোরবানির পশু কেনা, জবাই, কাটাসহ এ সংক্রান্ত নানা ধরনের ছবি।

ধর্ম আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দিলেও কর্মতৎপরতায়ই স্পষ্ট, এই শ্রেণিটি ভোগেই সুখের সন্ধান পান। কোন প্রেক্ষিতে যেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, ’সুখের কোনো পথ নেই। সুখই সেই পথ’। তার সাত শব্দের এ বাক্যের নানা অর্থ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকেই গৌতম বুদ্ধ সুখের এ সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, জীবনের চলার পথই গন্তব্য তত্ত্বের সঙ্গে মেলে অনেকটা।

প্রাচীন আমলের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের একজন সক্রেটিস মনে করতেন, সুখ বাহ্যিক জগত থেকে আসে না। তিনি বেঁচে ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের দিকে। তিনি বলেছিলেন, ’সুখের গোপন মন্ত্র হলো, খুব বেশি না চাওয়া। সেই সঙ্গে কম উপভোগের বিষয়টি আয়ত্ত করতে হবে’।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ অব্দের দিকের দার্শনিক প্লেটো। তিনিও সুখ নিয়ে কথা বলেছেন। ‘একজন মানুষ জীবনে যা করেন, সুখ লাভ তার ওপরই নির্ভর করে। তার সুখ অন্যদের ওপর নির্ভর করে না’। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো যে তার শিক্ষকের মতোই সুখের কথা বলবেন তা সাধারণ বিষয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর