ভ্রমণ

বিদেশের মাটিতে বিড়াল বিভ্রাট!

আমি এক সিঁড়ি উপরে উঠছি, আর ওটা ক্রমশ নিচ থেকে উপরে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে! আমি দ্রুত পিছু হটে এক দৌড়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। মনে হয় না জীবনে কখনো ভুলেও বিড়ালকে ভয় পেয়ে এভাবে তড়িঘড়ি করে সটকে পড়েছি! বিচিত্র এ জীবন আর তার রং-ঢং। ওটা আমার দরজার দিকেই আসছে। বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ওটা দরজার কাছে এসে কিছুক্ষণ নিচের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে চলে গেল।

Advertisement

আমি তো আর বের হওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারছি না! কিন্তুু বেজায় ক্ষুধা পেয়েছে! মনে পড়লো টরেন্টো এয়ারপোর্টে যে ডোনাটটি কিনেছিলাম, ওটার অর্ধেকটাই রয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে ওটা সাবাড় করলাম। কিছুটা স্বস্তি! এটা নিতান্তই নগণ্য! ভারি কিছু খেতে হবে। এই ভারি খাবার কানাডায় পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ! আর পাওয়া গেলেও এর সংজ্ঞাটা একেবারেই ভিন্ন হবে। আর কী করা যায়? পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না। দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল! মারসিয়া এসেছেন। বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই অনেক ক্ষুধার্ত। চলো নিচে যাই। তোমার জন্য খাবার রেখেছি, খাবে চলো।’ মনে হয় উনি চেহারার করুণ হাল দেখে বুঝে ফেলেছেন আমার অবস্থা ত্রাহি-ত্রাহি! তাই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনই বোধ করলেন না।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলাম। প্রথমবারের মত রান্নাঘরে- এর আগেরবার তো বিড়াল বিভ্রাটের সৌজন্যে কিছুই দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কানাডিয়ান রান্নাঘর! কোন জিনিসের কমতি নেই! মনে হচ্ছে সবকিছুই এখানে পাওয়া যাবে। আমার জন্য রাখা খাবার-দাবার, পাউরুটি, বনরুটি- যেটা গমের তৈরি, মধু, চা না কফি- আমি চা-ই বেছে নিলাম।

Advertisement

তারপর হলো বিড়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্ব! দুটোই মেয়ে বিড়াল- একটা কালো, আরেকটা সাদা। উনি বললেন, ‘খুবই শান্ত স্বভাবের’। শুধু একটা ব্যাপার বললেন, ‘যখন উল্টো হয়ে আড়মোড়া নেয়; তখন যেন কোনভাবেই গায়ে হাত না দেওয়া হয়।’ মনে মনে বলছিলাম, ‘আগে এগুলোকে এখান থেকে সরিয়ে দিন। আমি এগুলোর ধারে-কাছেও যাব না! বলা তো যায় না, কখন কী করে বসে?’

> আরও পড়ুন- শুভ্রতার স্পর্শে : প্রবাসীদের বিশ্বস্ততা

রুমে এসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি- বরফের পুরু স্তর জমেছে। মনে হচ্ছে এখানকার গাছপালা, বাগান সবুজ না, সাদা! সারা বছর কি এভাবেই থাকে? গাছে কোন পাতা নেই। সব কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে! আচ্ছা! আজকে মারসিয়াকে জিজ্ঞেস করবো, এখানে আসলে কয় মাস সবদিকে সবুজের সমারোহ দেখতে পাবো? কেমন লাগে তখন? গরমই বা কেমন? তখন কি এসি চালাতে হয়? এই বাসায় অবশ্য এসি নেই। তা অবশ্য কোন ব্যাপারই না। একটা ফোন, ব্যস! এখানে ফোন করে হয় না এমন কোন কাজ নেই। এক শুধু ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া! মানে হাসপাতালে না গেলে চিকিৎসা হবে কিভাবে?

আমার জিনিসপত্র কেনা দরকার। একটা লিস্ট করে ফেললে ভালো হয়। প্রথমেই যে জিনিসটি লাগবে সেটা হচ্ছে জুতো, বরফের বুট জুতো। যে জুতো পরে এসেছি; সেটা গরমের জন্য উপযোগী। এরপরে মোবাইলের চার্জার। ল্যাপটপের চার্জারও লাগবে। চাল, ডাল, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, মাংস, ডিম, দুধ আর প্রয়োজনীয় মসলাপাতি। কিন্তু ওনাকে এটা বলবো কিভাবে? কারণ এগুলো তো নিজের কেনার কথা। আর যেতেও হবে নিজেকেই। তাহলে এখন উপায় কী? সিদ্ধান্ত নিলাম- একবার ভদ্রভাবে বলে দেখবো, দেখা যাক কী হয়?

Advertisement

তখন প্রায় সাড়ে ৯টা। রাতের খাবার তো হয়েই গেল। মারসিয়াকে ‘শুভরাত্রি’ জানিয়ে চলে এলাম। বাসায় কল দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। আগেই অবশ্য ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম অ্যাপস দিয়ে। ওনারা জানেন, আমি পৌঁছে গেছি। কথা বলার চেষ্টা করলাম, হলো না। সময় জানিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকালে তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে গেল। নিচে চলে গেলাম। যথারীতি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারসিয়া চলে এলেন। ‘শুভ সকাল অতনু!’ রাতের ঘুম কেমন হলো জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ‘ক্লান্ত ছিলাম তাই ভালোই হয়েছে।’ আজকে রান্নার জিনিসপত্র থেকে আরম্ভ করে স্নো-বুট পর্যন্ত কিনতে হবে। কারণ যে জুতো জোড়া পরে এসেছি, ওগুলো এ জমজমাট হিমশীতলতায় নিতান্তই অকেজো।

গতকাল পর্যন্ত যে বিষয় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলাম, সেটার সমাধান হয়ে গেল। মারসিয়া প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নিশ্চয়ই জিনিসপত্র কিনতে হবে, চলো ওয়ালমার্ট যাওয়া যাক। আশা করি তোমার প্রয়োজনীয় অধিকাংশ জিনিসপত্র ওখানে পেয়ে যাবে। যাক বাবা! মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে অনেক বড় একটা পাহাড়সম বোঝা নেমে গেল!

> আরও পড়ুন- শুভ্রতার স্পর্শে : ক্লান্ত শরীরে ঘুমের দেশে

মায়ের ফোন! ‘বাবু, কী করো? খাওয়া-দাওয়া করেছ?’ ‘বাবু’ শব্দটি শুনলেই মনে হয়, কী মধুর! আহা! মায়ের নিজের দেওয়া ডাকনাম। আমাকে ভালোবাসার দেবতা বানানোর কৃতিত্ব ওনারই। অথচ আজ পর্যন্ত কখনো ওই নামে ডাকেননি! সবসময় সেই মধুময় ডাক- ‘বাবু’! বললাম, ‘হ্যাঁ, খেয়েছি, সব ঠিক আছে। কী রান্না হয়েছে বাসায়?’ মা বললেন, ‘মাছ-সবজি।’ আমি থাকতেও প্রায় সবসময় একটি জিনিসই রান্না হতো- মাছ! আশেপাশের বর্ণনা দিলাম। জানালাম, ‘সবকিছুই সাদা, মা!’ মা-ও বললেন, ‘যখন যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলাম, তখন ওখানে এমনই দেখেছি!’ তারপর বললেন, ‘বেশ বড় বড় কিছু সামুদ্রিক পাখি আছে, দেখেছো কিনা?’ ‘না, আরে পাখি কী দেখবো? মানুষেরই দেখা মেলা ভার! আশা করি, দেখতে পাবো!’

এমন সময় মারসিয়ার ডাক শুনতে পেলাম। মাকে ফোনে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। ‘চলো, বেরিয়ে পড়ি!’ এরপর উনি আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি সময়ের ব্যাপারে কতটা নিয়ম মেনে চল?’ বললাম, ‘আমি ডেন্টাল সার্জন। আমি সময় না মেনে চলতে চাইলেও সময়ের গতিপথ সবসময় আমার পিছু লেগেই থাকে।’ তারপর বললেন, ‘প্রথমে আমরা ওয়ালমার্ট যাব, ওখান থেকে আমি গির্জায় যাব। ঠিক ১০টা ২০ মিনিটে ফিরে আসবো তোমাকে নিতে।’ বললাম, ‘নিঃসন্দেহে!’

বেরিয়ে পড়লাম দু’জন! সাদা আর সাদা। এ যেন শুভ্রতার সাগরে হারিয়ে যাচ্ছি! মারসিয়া বললেন, ‘গ্রীষ্মকালে এমন থাকবে না। কেপ ব্রেটন দ্বীপপুঞ্জ কানাডার সর্বসেরা দশ জায়গার মধ্যে একটি। যেটা মৃত্যুর আগে অবশ্যই ভ্রমণ করা উচিত!’

আমরা পৌঁছে গেলাম ওয়ালমার্ট। উনি চলে গেলেন। ওয়ালমার্ট! এ তো দেখছি ব্যাপক বিশালত্ব! শুরু কোথায় আর শেষ কোথায়?

চলবে...

এসইউ/পিআর