মতামত

ঈদ-আনন্দের সঙ্গে মানুষের রাজনীতি-আতঙ্ক

ঈদ এসেই যায়, যতোই আমাদের জাতীয় জীবন বহুবিধ সমস্যা জর্জরিত হোক না কেন, বছর পরিক্রমায় ঈদ, পূজো বা বড়দিনের মতো আনন্দময় ঘটনা ঘটেই। কিন্তু প্রতিবারই মানুষ একটি মহা ভয় নিয়ে এই আনন্দ বিশেষ করে ঈদ উদযাপন করে থাকে। এই ভয় রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক দলগুলি গত প্রায় এক দশক ধরেই এই ভয় জনগণকে দেখিয়ে আসছে যে, ঈদের পর প্রবল আন্দোলন হবে এবং সে আন্দোলনে হয় সরকার পড়বে না হয় তারা ক্ষমতাসীন হবে।

Advertisement

অর্থাৎ আমাদের ঈদ-আনন্দের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে এই রাজনৈতিক ভয়টি যে, হয়তো ঈদ শেষে ফিরতে না ফিরতেই নতুন করে শুরু হবে অশান্তি, ব্যাহত হবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, কে জানে হয়তো আগুন-সন্ত্রাসে কেউ প্রাণ হারাবেন কিংবা সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হবেন। এই যে আতঙ্ক, এই যে ভয় আমাদেরকে দেখানো হয় রাজনীতির নামে, চলমান ঈদ আনন্দও তার থেকে মুক্ত নয় এবং আমাদের কাছে এই ভয় এখনই চেপে বসেছে যে, এবারের ঈদের পরের সময়টি গোটা দেশের জন্যই হয়তো সুখকর হবে না।

প্রথমতঃ সরকার এখনও পর্যন্ত দেশের নাগরিককে এই ভয় থেকে মুক্ত করতে পারেনি যে, দেশে একটি স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সকল নাগরিক নির্ভয়ে সেই নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে। সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে বলছে, যথাসময়ে সংবিধান মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু মানুষ সরকারের কাছে এর চেয়েও বেশি কিছু জানতে চায়। বিশেষ করে, সকল পক্ষকে নির্বাচনে আনতে সরকার কার্যতঃ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সেটাই মানুষের মূল জিজ্ঞাসা।

এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনো ইঙ্গিত বা চিহ্ন মানুষের নজরে আসেনি যাতে মনে হতে পারে সরকার দৃশ্যতঃ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে একটি অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, সরকারের পক্ষ থেকে এমনকি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে যে, অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তা যেনো সকলেই শুনছে কেবল, মেনে নিতে পারছে না। কারণ, ব্যাপারটা কি এতোটাই সহজ হবে?

Advertisement

নির্বাচন কমিশন চাইলেই একটি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দেবে এবং বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, পরিস্থিতি কি এখনও এতোটা স্বাভাবিক? মোটেও নয়। এতোটা দৃঢ়ভাবে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কথা বলার একমাত্র কারণ এই মুহূর্তে একটিই, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি।

সংবিধান মেনে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বটে কিন্তু বিএনপি’র পক্ষ থেকে এই নির্বাচনকে নির্বাচন বলেই মানা হয়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষ সরকারকে মেনে নিয়েছে এবং বিএনপির প্রায় ছয় মাস ব্যাপী চলা আগুন-সন্ত্রাসকে বা তারও আগে নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টাকে পরোয়া করেনি। এর কারণ মূলতঃ একটাই, বাংলাদেশের মানুষ যে পরিমাণ সহিংসতা, জীবন বিপন্ন করে তোলার মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে রাজনীতির নামে তাতে নতুন করে আর কোনো সহিংসতার প্রতি তারা সমর্থন জানায়নি।

সরকার টিকে গেছে এবং টিকে গিয়ে মানুষকে একটি স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছে। জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গে দৃশ্যমান উন্নয়ন মানুষকে সরকারের প্রতি সহনশীল হতে শিখিয়েছে। ফলে বিগত পাঁচ বছরে যতোবারই বিরোধী রাজনীতির পক্ষ থেকে মানুষকে মাঠে নামানোর চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এখানে আমরা বিতর্ক করতে পারি জমায়েতকে বা রাজপথ থেকে মানুষকে উঠিয়ে দেওয়ার সরকারি প্রচেষ্টা বিষয়ে কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে বড় কোনো বিপর্যয় ঘটতে দেয়নি সরকার। ফলে মানুষ এক ধরনের সহজাত স্বাভাবিক জীবন নিয়ে এক প্রকার স্বস্তিতেই আছে। কিন্তু ভয়টা ভেতরে ভেতরে থেকেই গেছে যে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কী হবে? কী ঘটবে নির্বাচনের সময়? বিরোধী দল কী করবে? আগুন-সন্ত্রাস দিয়ে বাধা সৃষ্টি করবে? নাকি অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় হাঁটবে রাজনৈতিক দলটি?

এসব প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আমরা এগুলে দেখতে পাই যে, বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী রাজনৈতিক দলগুলি প্রত্যেকটি সম্ভাবনাকে সামনে নিয়েই এগুচ্ছে। যে কোনো মূল্যে এবার তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে হবে কারণ এই দলটি একটি ক্ষমতা-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল। ক্ষমতার বাইরে গেলেই এদের সকল কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। অপরদিকে ক্ষমতায় গেলে দলটি এতোটাই শক্তি প্রদর্শনে মেতে ওঠে যে, সারা দেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গীবাদ লালিত হয় এবং মেয়াদশেষে দলটি উদ্বোধন করার মতো কোনো স্থাপনা খুঁজে পায় না জনগণকে দেখানোর জন্য হলেও।

Advertisement

২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যখন ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় তখন সত্যিকার অর্থে এমন কোনো বড় স্থাপনা ছিল না যা তারা উদ্বোধন করতে পারেন। মানুষের স্মৃতি থেকে সেসব মুছে গেছে মনে করার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু তারপরও বিএনপি এদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল এবং দলটির রয়েছে বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী। সবচেয়ে বড় কথা হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদ শেষে যে বিশাল বিরোধী-ভোট ব্যাংক তৈরি হয়েছে তাদের সমর্থনও নিঃসন্দেহে বিএনপি’র দিকেই বেশি।

এমতাবস্থায় দলটি নির্বাচনে গেলে নিঃসন্দেহে একটি গণজোয়ার তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই রয়েছে। কিন্তু কার্যতঃ এটাই লক্ষ্যমান যে, দলটি জনসমর্থনের এই অঙ্কের ওপর ভিত্তি করে কোনো ভাবেই নির্বাচনে যেতে চাইছে না। তারা এর বাইরে মূলতঃ চার/পাঁচটি শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো দুর্নীতির দায়ে সাজা প্রাপ্ত দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, তার পুত্র দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।

এর বাইরে যে সব শর্ত রয়েছে সেগুলো যদি বাদও দিই, তাহলেও সরকারের পক্ষে বেগম জিয়া ও তারেক জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার মতো জাদুকরী ক্ষমতা আছে কিনা সে প্রশ্নটি থেকেই যায়? যে আইনী প্রক্রিয়ায় তারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন সেই একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদেরকে মুক্ত হয়ে আসতে হবে এবং সেটি নিঃসন্দেহে দীর্ঘ।

ততোদিন কি নির্বাচন বসে থাকবে? যদি বসে না থাকে তাহলে বিএনপি আসলে কী করবে? মানুষের ভয়টি সে জায়গাতেই। কারণ, বিএনপি কখনওই একটি জনপ্রিয় গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার মতো ক্যারিশমাটিক রাজনৈতিক দল নয়। তারা সব সময় অন্যের আন্দোলনকে ভর করে কিংবা ষড় করে ক্ষমতা পেতে অভ্যস্ত। কোটা থেকে শুরু শিশু-কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে বিএনপি ভর করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেই ব্যর্থতার দায় টানতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে।

স্বাভাবিক ভাবেই সরকার নিজেকে বাঁচাতে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদেরকে বিরোধীপক্ষ বিবেচনায় কঠোর হয়েছে, নাহলে একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে মেনে নিয়ে সরকার যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছিল তাকে কোনো ভাবেই সরকারের অবস্থানকে নেতিবাচক প্রমাণ করে না। কিন্তু যে মুহূর্তে এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের প্রমাণ মিলতে শুরু করলো সে মুহূর্ত থেকেই সরকারও কঠোর হয়েছে। একে যৌক্তিক কি অযৌক্তিক সে ব্যাখ্যায় না গিয়েও বলা যেতে পারে যে, এক্ষেত্রে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকলেও একই রকম কাজ করতো কিংবা এর চেয়েও কঠোরতা আমরা দেখতে পেতাম।

প্রশ্ন হলো এতোগুলো নেতিবাচক সম্ভাবনা বা ভয়-ভীতি নিয়েই মানুষ ঈদ উদযাপন করছে এবং ঈদ-শেষে ফিরে আসবে এক ভয়ঙ্কর ভয় নিয়ে, এরপর কী হবে? মূলতঃ ঈদের পর বিএনপি ও মিত্ররা কী ভাবে বা কোন্ প্রক্রিয়ায় সরকারকে বাধ্য করবে তাদের দাবি মানতে আর সরকার কী ভাবে বা কোন্ প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের এসব পদক্ষেপকে ঠেকাবে? আর এসব পক্ষ-বিপক্ষের কঠোর অবস্থানের ভেতর থেকে কী ভাবে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? আর যুযুধান বা বিবদমান পক্ষগুলির মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনের কী হবে?

এই প্রশ্নগুলির প্রত্যেকটিরই উত্তর আমাদের জানা নেই আর যা কিছু অজানা তাই-ই ভীতির সৃষ্টি করে। মানুষের ঈদ-যাপন এমনিতেও শান্তিময় নয় এবার কারণ মাত্রই একটি আন্দোলন ও অচলাবস্থা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে, এরপর সামান্য সময়ের ব্যবধানে আবার যদি নতুন করে অচলাবস্থা শুরু হয়, মানুষ কি সেটা মেনে নেবে কোনো ভাবেই? যদিও এদেশে সাধারণ মানুষের কথা কে-ই বা কোন্ কালে ভেবেছে বলুন? এতোসব অনিশ্চয়তার পরও ঈদ আনন্দময় হোক সবার, সেটাই কামনা।

ঢাকা ২০ আগস্ট, সোমবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/পিআর