মতামত

বাসযোগ্যতায় তলানীতে ঢাকা

ঢাকা খুব অসুস্থ। অসুখের তালিকা খুব দীর্ঘ। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু কি সেই চিকিৎসা তা জানা নেই। যুক্তরাজ্যের দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৮ সালের গ্লোবাল লিভেবলিটি ইনডেক্স বা বৈশ্বিক বসবাসযোগ্যতার সূচকে আমাদের রাজধানী নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় হয়েছে। বসবাসের জায়গা হিসেবে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক সবচেয়ে খারাপ, আমাদের ঢাকা তার একটু ওপরে।

Advertisement

আমরা সান্ত্বনা পেতে পারি এই ভেবে যে, আমরা দামেস্কের উপরে আছি। প্রতিদিন অসংখ্য বিমান হামলা, বন্দুক-কামানের গর্জন, গেরিলা হামলায় লাখ লাখ বাস্তুহারা মানুষের শহর দামেস্কের পরের স্থানটি পেয়েছে ঢাকা। এর মানে হচ্ছে দামেস্কের পর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাগরিকরা সবচেয়ে বাজে অবস্থায় বসবাস করছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে শহরের বাসযোগ্যতার মানদণ্ড হিসেবে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ ও সংস্কৃতি, পরিবহনব্যবস্থা, অবকাঠামোসহ ৩০টি বিষয় আমলে নেয়া হয়েছে।

ঢাকাকে বলা হয় বস্তির শহর, কংক্রিটের নগর, যানজট, জনজট স্বাভাবিক তার জীবনজুড়ে, কোলাহলে পূর্ণ তথা শব্দদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বায়ুদূষণ পরিবেশদূষণ, বর্জ্যদূষণ মিলিয়ে এক নারকীয় অবস্থা বৈকি। ঢাকা নাগরিক সুযোগ সুবিধাগুলোর বিধান না রেখেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তার নগরায়ণ হচ্ছে জঞ্জালপূর্ণতায়। তিলোত্তমা নগরীর স্বপ্ন তবু এরই মাঝে দেখানো হয়, শেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে এ শহরে থাকা মানে দুঃস্বপ্নে বাস করা।

ঢাকায় আমরা থাকি। কিন্তু এ থাকায় কোন আনন্দ নেই। দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে বাড়ছে শহরে থাকার ঝোঁক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ আসছের ঢাকায়। শহরের উন্নত জীবনের সংজ্ঞায় ঢুকে পড়েছে জীবনের গতি। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে গতির চাহিদা। বাড়ছে রাজপথ, শহর হচ্ছে স্মার্ট, মানুষের চাহিদায় ফোর/ফাইভ জি-র গতি। বাড়ছে শহরের বুকে গাড়ির মিছিল হই-হই করে। তার সঙ্গেই বাড়ছে কার্বন-পোড়া বিষ। বিষ ছড়াচ্ছে হাওয়ায়, আর আমরা প্রতিনিয়ত অসুখে পড়ছি।

Advertisement

ঢাকায় থাকলে সবচেয়ে যে সমস্যা প্রতিদিন সইতে হয় তাহলো যানজট। ঢাকার রাস্তায় এত যানজট কেন? আর এর সমাধানই বা কী? এই প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর নেই। তবে চেষ্টা করা হয়েছে উপর দিয়ে কিছু গাড়ি পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করার। অনেকেই বলবেন, গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে তাই যানজট বেড়েছে। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা বাড়লেই যানজট হবে, এই ধারণাটি অতি সহজ।

আসলে আমাদের রাজধানীতে পরিবহন কাঠামোর অপ্রতুলতা ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা একে উত্তরোত্তর গতিহীন করে তুলেছে। সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ততার মাঝে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় ৬/৭ কিলোমিটারের মতো। আর এই গতিহীনতার কারণে জীবন থেকে কত সময় চলে যাচ্ছে তার হিসাব কেউ দেবে না।

ঢাকা শহরের মোট আয়তনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ ৮ শতাংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক আদর্শ মান হচ্ছে ২৫ শতাংশ। আর ওই রাস্তার ওপর দিয়ে সিংহভাগ যানবাহন যদি ছোটার চেষ্টা করে, তা হলে সেই রাস্তা স্বভাবতই গতিহীন হবে। আজ থেকে তিন দশক আগেও দেশের বিভিন্ন শহরে যাত্রী পরিবহনে গণ-পরিবহন ব্যবস্থা ছিল মূলত বাস অথবা লোকাল ট্রেন-নির্ভর। ধীরে ধীরে সেটির পরিবর্তন ঘটল প্রাইভেট গাড়ি বাড়ার কারণে। আমরা মুখে বলি রেল ব্যবস্থা যাত্রী পরিবহনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাস্তবে সড়ক পরিবহনেই আমাদের সব পরিকল্পনা।

একই রাস্তায় ধীরগতির রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটো ও সিএনজি ও এবং একই সাথে গতিশীল গাড়ি সব মিলে এখন এক সাথে থমকে থাকে। শহরের রাস্তাগুলি বর্ধিত যানবাহনের চাপ সামলিয়ে গতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, মাত্র আট শতাংশ রাস্তারও ৩০ ভাগের মতো দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে৷ এছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী৷ ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট৷ তাহলে চলবে কি করে এই শহরটি?

Advertisement

ঢাকার যে প্রান্তেই যাওয়া হবে দেখা যাবে চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। দীর্ঘ দিন ধরে উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট কেটে রাখায় এ শহরে আর কেউ বাস করতে পারছে না। একেকটা প্রকল্পের নামে তখন যে পরিমাণ গাছ কাটা হয় তাতে এ শহরে বস্তুত কোন অক্সিজেন নেই। দুই কোটির বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি মেগাসিটির যে ধরনের রাস্তা, গণপরিবহনব্যবস্থা, স্যুয়ারেজ, পানি, বিদ্যুত,গ্যাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, উদ্যান, বিনোদন কেন্দ্র, আবাসন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ঢাকায় তার কিছুই নেই।

ঢাকায় কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলন নাকি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু চোখ কেন বন্ধ ছিল তার জবাবদিহিতা নেই। একদিকে সরকার উন্নয়নের কথা বলছে, মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার কথা বলছে, অন্যদিকে দেশ বিনিয়োগ পরিবেশ হারাচ্ছে, দেশের রাজধানী শহর বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নতুন ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে। এতে যানজট বা জনদুর্ভোগ কমেনি।

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দখল ও দূষণরোধসহ শহর থেকে শ্রমঘন ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কলকারখানা সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নগরবিদরা। গত পাঁচ দশকে গড়ে ওঠা শত শত বস্তিতে মানবেতরভাবে বাস করছে লাখ লাখ মানুষ।

শুধু বস্তি উচ্ছেদের মাধ্যমে নগরীর অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কমানোর উদ্যোগ সফল হবে না। ঢাকায় গড়ে ওঠা কলকারখানা, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ ও ঢাকার চারপাশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমেই কেবল ঢাকা শহরকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপমুক্ত করা যেতে পারে।

এ লক্ষ্যে প্রথমেই যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা থেকে রিকশা তুলে দিতে হবে। অনেকেই দরিদ্র এসব মানুষের কর্মসংস্থান নিয়ে কথা বলবে। এতে করে কখনোই ঢাকাকে গতিশীল করা যাবে না। আর রিকশা চালানো কোন উৎপাদনশীল কাজও নয়।

গার্মেন্টস কারখানাসহ সব ধরনের কলকারখানা সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার শিল্পকারখানা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি গাজীপুর, সাভার, ধামরাই, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, পূর্বাচলের আবাসন, শিল্পায়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

রাজধানীকে রাজধানীর মর্যাদা দিতে হলে সবার আগে দরকার সব ধরনের শিল্পকারখানা পর্যায়ক্রমে সরিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া। এছাড়া রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের খালবিল ও নিম্নভূমি জলাধার সংরক্ষণের লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে পরিকল্পিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক।

এসব স্থানান্তর হলে শহরে জনসংখ্যার চাপ যেমন কমবে, তেমনি একে কেন্দ্র করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনাসমূহও দূরীভূত হবে। এতে বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার পথে অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই শহরে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে চলতে চাই। তাই শহরের মূল রাস্তাগুলোকে বিপদমুক্ত করার তাগিদেই ফুটপাথের হকারমুক্তি চাই। দরিদ্রদের প্রতি দরদ দেখাতে দিয়ে দারিদ্র্য নিয়ে ব্যবসা চাই না। শহরকে গগনচুম্বী করার অনুমোদন দেওয়ার আগে সরকার ভাবুক। শহরের পরিবহন কাঠামোর আধুনিকীকরণের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই শহরের যান নিয়ন্ত্রণ ভাবনা সূত্রায়িত করা দরকার।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/আরআইপি