প্রিয় সারওয়ার ভাই,আপনার কাছে কাজ ছিল উপাসনা- যা করতেন পরিপূর্ণ ধ্যানে- মগ্নতায় সম্পন্ন করতেন। ছিলেন সার্বক্ষণিক সংবাদকর্মী। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুকেও কামনা করতেন ‘বার্তাকক্ষে’। যেন মৃত্যুদূতের ‘সময় শেষ’ এই বার্র্তায় হাসিমুখে তার আহ্বানে চলে যেতে পারেন অমরালোকে।
Advertisement
আমরা যারা ‘বার্তাকক্ষে’ আপনার সঙ্গে কাজ করেছি তাদের কাছে আপনার এই চলে যাওয়া, এই শূন্যতা এক অপূরণীয় হাহাকারের মতো। সেই শূন্যতাকে লিখে ব্যক্ত করা অসম্ভব। আপনি আজ ভাষার অতীত, আপনি আজ এক অব্যক্ত বোধ- আপনার সঙ্গে কাজ করা সহকর্মীরা আপনার শূন্যতায় বাকরুদ্ধ বটে তবে বোধরুদ্ধ নয়। আর সেই বাকরুদ্ধ বোধ নিয়ে সবাই আপনার নিস্পন্দে ফিরে আসার প্রহর গুনছি। আপনাকে শেষবারের মতো ভালোবাসা জানানোর জন্য।
কত কথা, কত স্মৃতি আপনার সঙ্গে- সেসব স্মৃতি আর কথার ভিড় উজিয়ে যা আজকে ব্যক্ত বলে বোধ হচ্ছে তা হল- আমরা আপনার মতো এক মহান অভিভাবককে হারালাম। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জগৎ হারাল তার এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে। একই সঙ্গে পিতা-ভাই-বন্ধু- এমন ব্যক্তিত্ব এ যুগে বড়ই দুর্লভ। আমার দীর্ঘ সময় আপনার সামনে বসে কাজ করার, আপনার অকৃত্রিম সাহচর্যের স্মৃতি চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে- এই লেখাটি লিখতে বসে।
আপনার কাছ থেকে অনেক কাজ শিখেছি। সহকর্মীদের কাছে আপনি যেমন ছিলেন শিক্ষক, গুরু তেমনই আপনি নিজেও সব সময় আপডেট থাকতেন তত্ত্ব-তথ্যে তরুণ সহকর্মীদের কাছে থেকেও। ‘শেখানো’ এবং ‘শেখা’র এই পরম্পরা থেকে আপনি কখনও বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তা ছিলেন না বলেই আপনার পঁচাত্তর বছর বয়সেও ‘বার্তাকক্ষে’ বসে শেষ কপিটি ছাড়ার পর আপনি ছুটি নিতেন। ঘড়ির কাঁটা আপনাকে ছুটি দেয়নি কখনও, আপনি তাকে ছুটি না দিলে। আজ আপনি চিরদিনের জন্য ছুটি নিলেন। এক সময় সংবাদপত্রের অফিসে সর্বক্ষণ টেলিপ্রিন্টারের শব্দ শোনা যেত। তখন কম্পিউটার ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না- আপনাদের প্রজন্মের শুরুতে। আজ যেন ‘বার্তাকক্ষে’র সেই টেলিপ্রিন্টারটি স্তব্ধ হয়ে গেল।
Advertisement
এ দেশের সংবাদপত্রের বাঁক বদলের কাণ্ডারি ছিলেন আপনি। মনে আছে দৈনিক যুগান্তরের সূচনা পর্বের কথা। আপনার আগে বাংলাদেশের কোনো সম্পাদক দেশের মফস্বল শহরের ধুলায় পা রাখেননি। দীর্ঘ ২৭ বছরের নিশ্চিত জীবন পেছনে ফেলে আপনি এক দুরন্ত ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছিলেন- যার অন্য নাম দৈনিক যুগান্তর। আপনি জীবন নিয়ে জুয়ায় মাতেননি, মেতেছিলেন এক নতুন লড়াইয়ে। যে লড়াইয়ে জয়ই একমাত্র লক্ষ্য। দৈনিক যুগান্তর প্রকাশের আগে দেশের মফস্বলগুলোর ধুলোয় আপনার পা-ই কেবল পড়েনি- সে ধুলো উড়িয়ে দিতে আপনি যুগান্তরের পৃষ্ঠায় এক সবুজ সজীব দেশকে তুলে ধরার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। আপনি বাংলাদেশের প্রাণকে রোপণ করেছিলেন যুগান্তরের পাতায়- আজও যুগান্তরের গর্ব ও গৌরব, শেকড় বিস্তারী স্লোগান- ‘পাঠকের অন্তরজুড়ে যুগান্তর’।
আপনার সুদীর্ঘ সংবাদপত্রের জীবনে কীর্তিময় সাংবাদিকতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সেটা যেমন বিনোদন, সংস্কৃতি, সাপ্তাহিক পূর্বাণী সম্পাদনায়, তেমনই একটি পূর্ণাঙ্গ দৈনিকরূপে যুগান্তর প্রতিষ্ঠায়। সংবাদপত্রের বাঁক বদলের কীর্তিময় অধ্যায়ে আমরা আপনার সঙ্গে থাকার সৌভাগ্যের অধিকারী। বাংলা সংবাদপত্র জগৎকে সুসংহত করার কাজে যে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিত্ব অবদান রেখেছেন আপনি তাদের অন্যতম একজন। রুশ বিপ্লবের নেতা ভ. ই. লেনিন বলেছিলেন- ‘সংবাদপত্র হচ্ছে জনগণের শিক্ষক।’ বিপ্লবের মুখপত্র ‘ইস্ক্রা’ সম্পাদনা করতে গিয়ে তাঁর উপলব্ধি ছিল এমনটিই। আপনি জনগণের শিক্ষক হননি, হয়েছিলেন তাঁদের ছাত্র। আপনি তাঁদের কাছ থেকে শিখেছেন এবং সেই শিক্ষা আবার তাঁদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
না, আপনি কোনো বিপ্লবের নেতা ছিলেন না কিন্তু ছিলেন সার্বক্ষণিক সংবাদকর্মী- সংবাদের ফেরিওয়ালা। আর সংবাদের ফেরি করতে করতেই আপনি উপলব্ধি করেছেন, সংবাদকেও হতে হবে বিপণনযোগ্য, ফেরি করার উপযোগী। তাই যখন সংবাদ মানেই দুঃসংবাদ, সে রকম একটা সময়ে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের প্রথম কলামে ছাপা হতো প্রতিদিন ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’ নামে একটি সুসংবাদ। ‘লাল-সবুজ’ লোগোতে ছাপা হওয়া সেই কলামটিই বলে দিত আমরা যুগান্তরের সংবাদকর্মীরা বাংলাদেশে কোন সংবাদের প্রত্যাশায় নির্ভীক। আমরা এক ইতিবাচক বাংলাদেশের আকাক্সক্ষায়, স্বপ্নে নিবেদিত ছিলাম।
যেন চকমকিত পাথর ঠুকে আগুন জ্বালানোর প্রচেষ্টা- ছোট ছোট পদক্ষেপ কিন্তু বড় বড় পরিবর্তনের সূচনা-বিন্দু। দৈনিক যুগান্তরের ‘ঈদ ম্যাগাজিন’ আপনার প্রবর্তনা, যা আজ দেশের সব দৈনিক পত্রিকা অনুসরণ করে।
Advertisement
কত রাত্রি কেটে গেছে নির্ঘুম- আপনার সঙ্গে। যখন আমরা আলোচিত ইস্যুগুলোতে ‘টেলিগ্রাম’ বের করেছি। বার্তা সম্পাদক, চিফ রিপোর্টার, সাব-এডিটর, কম্পিউটার অপারেটর, পেস্টার, প্রেসের মেশিনম্যান এমনকি বাইন্ডার পর্যন্ত সবাইকে ঘুম থেকে তুলে ক্যাপ্টেনের মতো মেকআপ প্লেট শেষ করে টেলিগ্রাম মেশিনে তুলে দিয়ে নাস্তায় বসেছেন আমাদের নিয়ে। শুধু তাই নয়, সে সময়ও আপনি সেলফোনে উৎকর্ণ থেকেছেন অকুস্থল থেকে সংবাদের সর্বশেষ আপডেট পেতে।
পত্রিকা নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া সার্কুলেশনের গাড়ি মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে সর্বশেষ আপডেট সংবাদ ছাপা পত্রিকা পাঠকের হাতে পৌঁছে দেবে বলে। ‘সংবাদ’ নিয়ে এমনই আপসহীন ছিলেন আপনি।
হেডপিস থেকে শেষ পৃষ্ঠার প্রিন্টার্স লাইন পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে দায়িত্ব পালন করতেন আপনি। আপনার চোখের ‘স্পর্শ’ ছাড়া একটি পৃষ্ঠাও মুদ্রিত হতো না- যা একজন সত্যিকার সম্পাদকের দায়িত্বের অংশ। আপনি সেই দায়িত্ব পালনে ছিলেন ক্লান্তিহীন। আপনার মননের স্পর্শে, আপনার মেধার স্পর্শে, আপনার প্রজ্ঞা ও বোধের স্পর্শে নিউজপ্রিন্টের সাদা কাগজের পৃষ্ঠাগুলো বর্র্ণবিভায় বাক্সময় বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠত। দৈনিক যুগান্তর ছিল আপনার হাতে বাংলাদেশের বাঁশি, বাংলাদেশের সুরধ্বনি। তাই আজও পাঠকের অন্তরে তার অবস্থান।
রবীন্দ্রনাথ আপনার প্রিয় কবি ছিলেন। প্রতিদিন উত্তরার বাসা থেকে কমলাপুর যুগান্তরের অফিস পর্যন্ত আসার সময় আপনার সঙ্গী ছিল সঞ্চয়িতা কিংবা গল্পগুচ্ছ। কখনও হুমায়ূন আহমেদের শেষ বইটি। আপনি এই ধুলি-ধূসরিত বাংলাদেশকে রবীন্দ্রনাথের মতোই তুলে নিয়েছিলেন অন্তরে, আপনি যেন পৃথিবীকে তার ভাষায় এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন- ‘ব’লে যাব তোমার ধূলির তিলক পরেছি ভালে’- বলেছিলেন তাঁর ভাষায়-
‘‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি-
অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি
এই মহামন্ত্রখানি,
চরিতার্থ জীবনের বাণী।
দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা-কিছু উপহার
মধুরসে ক্ষয় নাই তার।
তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে-
সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দ বিরাজে।
শেষ স্পর্শ নিয়ে যাব যবে ধরণীর
ব’লে যাব তোমার ধূলির
তিলক পরেছি ভালে,
দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে।
সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মুরতি,
এই জেনে এ ধুলায় রাখিনু প্রণতি।”
অমরালোকে ভালো থাকবেন প্রিয়স্বজন, স্রষ্টার কাছে এটাই কামনা।লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, যুগান্তর।
এইচআর/পিআর