এক.সেই রাত্রির কল্পকাহিনী
Advertisement
তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,তারপর তোমার জন্মসহোদর, ভাই শেখ নাসেরতারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,আমাদের নির্যাতিতা মা।
এরই ফাঁকে একসময় ঝরে গেছে তোমার বাড়িরসেই গরবিনী কাজের মেয়েটি, বকুল।এরই ফাঁকে একসময় প্রতিবাদে দেয়াল থেকেখসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের দরবেশ মার্কা ছবি।এরই ফাঁকে একসময় সংবিধানের পাতা থেকেমুছে গেছে দু’টি স্তম্ভ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।এরই ফাঁকে একসময় তোমার গৃহের প্রহরীদের মধ্যেমরেছে দু’জন প্রতিবাদী, কর্ণেল জামিল ও নাম না-জানাএক তরুণ, যাঁর জীবনের বিনিময়ে তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো।
তুমি কামান আর মৃত্যুর গর্জনে উঠে বসেছো বিছানায়,তোমার সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরেছো চোখে,লুঙ্গির উপর সাদা ফিনফিনে ৭ই মার্চের পাঞ্জাবী,মুখে কালো পাইপ, তারপর হেঁটে গেছো বিভিন্ন কোঠায়।সারি সারি মৃতদেহগুলি তোমার কি তখন খুব অচেনা ঠেকেছিলো?তোমার রাসেল? তোমার প্রিয়তম পত্নীর সেই গুলিবিদ্ধ গ্রীবা?তোমার মেহেদীমাখা পুত্রবধুদের মুজিবাশ্রিত করতল?রবীন্দ্রনাথের ভূলুন্ঠিত ছবি?তোমার সোনার বাংলা?
Advertisement
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার আগে তুমি শেষবারের মতোপাপস্পর্শহীন সংবিধানের পাতা উল্টিয়েছো,বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে এক মুঠো মাটি তুলে নিয়েমেখেছো কপালে, ঐ তো তোমার কপালে আমাদের হয়েপৃথিবীর দেয়া মাটির ফোঁটার শেষ-তিলক, হায়!তোমার পা একবারও টেলে উঠলো না, চোখ কাঁপলো না।তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্যএকজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি।কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজনশ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা।
তুমি হাত উঁচু করে দাঁড়ালে, বুক প্রসারিত করে কী আশ্চর্যআহবান জানালে আমাদের। আর আমরা তখন?আর আমরা তখন রুটিন মাফিক ট্রিগার টিপলাম।তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করে হাজার হাজার পাখির ঝাঁকপাখা মেলে উড়ে গেলো বেহেশতের দিকে…।… তারপর ডেডস্টপ।
তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে, গড়াতে, গড়াতেআমাদের পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে থামলো।– কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামলো না।সিঁড়ি ডিঙিয়ে, বারান্দার মেঝে গড়িয়ে সেই রক্ত,সেই লাল টকটকে রক্ত বাংলার দূর্বা ছোঁয়ার আগেইআমাদের কর্ণেল সৈন্যদের ফিরে যাবার বাঁশি বাজালেন।
দুই.
Advertisement
স্বাধীনতা- এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়েলক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছেভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : ‘ কখন আসবে কবি ` ?এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না ,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না ,এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না ৷তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি ?তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে , বেঞ্চে, বৃক্ষে , ফুলের বাগানেঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি ?
জানি , সেদিনের সব স্মৃতি , মুছে দিতে হয়েছে উদ্যতকালো হাত ৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজকবির বিরুদ্ধে কবি ,মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ ,বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল ,উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান ,মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷
হে অনাগত শিশু , হে আগামী দিনের কবি ,শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমিএকদিন সব জানতে পারবে ; আমি তোমাদের কথা ভেবেলিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প ৷সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর ৷না পার্ক না ফুলের বাগান — এসবের কিছুই ছিল না ,শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যেরকম , সেরকম দিগন্ত প্লাবিতধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা , সবুজে সবুজময় ৷আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিলএই ধু ধু মাঠের সবুজে ৷
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধেএই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক ,লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক ,পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক ৷হাতের মুঠোয় মৃত্যু , চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত ,নিম্ন মধ্যবিত্ত , করুণ কেরানী , নারী , বৃদ্ধ , বেশ্যা , ভবঘুরেআর তোমাদের মত শিশু পাতা - কুড়ানীরা দল বেঁধে ৷একটি কবিতা পড়া হবে , তার জন্যে কী ব্যাকুলপ্রতীক্ষা মানুষের : " কখন আসবে কবি " ? " কখন আসবে কবি " ?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে ,রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটেঅত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন ৷তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল ,হৃদয়ে লাগিল দোলা , জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ারসকল দুয়ার খোলা ৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী ?গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর - কবিতা খানি :" এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম "৷
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। তিন.
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপগতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানেআমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,ভালোবাসা আছে- শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকালআমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক-আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়েআমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথারাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
এইচআর/পিআর