মতামত

দানবের জয় : সড়কে দাপটের ষোলকলা

পরিবহন সেক্টরে বড় ধরনের পরিবর্তনের আশা-ভরসা মাঠে মারা গেছে গত ক’দিনে। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের দেশ কাঁপানো রাষ্ট্র মেরামত আন্দোলনের পর সড়ক-মহাসড়কে আবারও একই দশা। চিটিংয়েরই জয়। ক্ষেত্রবিশেষে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আরো বেপরোয়া। আরো দানবীয়।

Advertisement

যার জেরে সড়কে মৃত্যুর মিছিল না থেমে তা আরো বাঁধভাঙ্গা। আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিছুদিন মাঠ গরম করা শিক্ষার্থী, সুশীলসহ সংশ্লিষ্টরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন কতো ধানে কতো চাল। সামনে আরো পাবেন। ভবিষ্যতে এ ইস্যুতে মাঠে নামার মুরোদ আর তাদের হবে কি-না সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।

একদিকে, তাদের এ নাহালত, আরেকদিকে পরিবহন জগতের সম্রাট শাজাহান খানের সাম্রাজ্য শুধু অঁটুট নয়, আরো সুরক্ষিত হয়েছে। তার হাসিতে কদিন একটু-আধটু কাউর লাগলেও সেটা মিটে গেছে। এই খুশিতে বগল বাজাচ্ছে তার সাগরেদ-সাহাবা, মুরিদানরা। এ আহ্লাদে এরইমধ্যে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িতেও একটু পরশ বুলিয়েছে। ঘটনাচক্র বা ভাগ্যগুণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রাণ যায়নি অন্যদের মতো।

যানবাহনের ফিটনেস না থাকা এবং বিনা বা জাল লাইসেন্সে অপ্রাপ্ত বয়সী, নেশাগ্রস্তদের গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে চেপে বসাও কমেনি। বিজয়ীর বেশে তা আরো বেড়েছে। এক হিসাবে জানা গেছে, অবৈধ ড্রাইভারই রয়েছে ১৮ লাখের মতো। আর শুধু ঢাকাতেই আনফিট যানবাহন আড়াই লাখের কাছাকাছি।

Advertisement

আসলে রেষারেষি ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অপরাধী হিসেবে শুধু কিছু উচ্ছৃঙ্খল ড্রাইভারকে চিহ্নিত করলে তা একতরফা হয়ে যায়। এর পেছনে মালিকদের সম্পৃক্তা অনেক। বিশেষ করে ড্রাইভারদের চুক্তিতে বাস-মিনিবাস চালাতে বাধ্য করেন তারা। মালিকদের নজর শুধু চুক্তির টাকা উশুলের দিকে।

চুক্তির দরদাম ও লাভ হাতাতে গিয়ে ড্রাইভার-হেলপাররা রীতিমতো হায়েনার মতো হয়ে ওঠে। কত কম সময়ে কত বেশি ট্রিপ দিয়ে কত টাকা হাতানো যায় সেই দৌড়ে নামে। তাদের গাড়ির নিচে মানুষ, গরু, ছাগল কী মরলো সেদিকে তাকানোর দরকার মনে করে না। এ নিষ্ঠুরতার তথ্য পুলিশ, বিআরটিএসহ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় কারোই অজানা নয়।

রমিজউদ্দীন কলেজের দুই শিক্ষার্থীই বাসচাপায় প্রথম বা শেষ মৃত্যু নয়। এর আগে, কলেজছাত্র রাজীবের হাত কাটা পড়া এবং হাসপাতালে তাঁর করুণ মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হয়। কিন্তু এতে পরিবহন মালিক, ড্রাইভার-হেলপার কারোই গায়ে তেমন বাতাস লাগেনি।

দুর্ঘটনায় জনে-জনে, ডজনে-ডজনে মৃত্যুর কাফেলা চলতেই থাকে। এ ধারাবাহিকতায় ২৮ জুলাই জাবালে নূর নামের ঘাতক পরিবহনের দুটি বাসের রেষারেষিতে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু।

Advertisement

একে হত্যাকাণ্ড দাবি করে দেশে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এ ভূখণ্ডের গত শতাব্দীর ইতিহাসে আলোড়িত ঘটনা। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয় সরকার, প্রশাসনসহ বড়দের। এ টর্নেডো থেকে বাদ যাননি মন্ত্রী, এমপি, পদস্থ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, এমনকি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও। কিন্তু দিন কয়েক রেস্ট নেয়া ছাড়া তেমন ঘা পড়েনি খানদের রাজ্যে। আর খানের হুকুমতও টলেনি।

পরিবহন সেক্টরের দাপুটে নেতা হওয়ায় সড়কে দুর্ঘটনা, নৈরাজ্যের যাবতীয় দায় বর্তাচ্ছে নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানের ওপর। অথচ সড়কসংশ্লিষ্ট নীতি বাস্তবায়নের বিশেষ দায়িত্ব সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর। সাত বছর ধরে ওবায়দুল কাদের এই মন্ত্রণালয়ে আছেন। তার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই অবনতির গতি বেড়েছে। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে বক্তৃতা-বিবৃতির নফল বন্দেগিতে যতো ব্যস্ত, তার সিকিভাগ ব্যস্তও নন ফরজ কাজে।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের দাবি, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের বিষয় নয়। সড়কের নিরাপত্তায় শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো আইনের বাইরে নয়। বিষয়টি মালিক-চালক, বিআরটিএ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়ার মতো নয়।

দীর্ঘকাল ধরে অনিয়মকেই নিয়মে রূপদানকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনার কী পদক্ষেপ নেয়া হলো? কিছু মামলা, জরিমানা, আটকসহ বিভিন্ন দণ্ডের খবর গণমাধ্যমে প্রচারের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। লাখ লাখ মামলা বা কোটি টাকা জরিমানায় সড়কে নৈরাজ্যের লাগামে টান ফেলতে পারেনি।

ট্রাফিক সপ্তাহের সাত দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধলাখ নিহতের ঘটনা কী প্রমাণ দেয়? এছাড়া সড়কে চুক্তিভিত্তিক বাস চালানোর বিরুদ্ধে মালিকদের অ্যাকশন নিয়ে এরইমধ্যে নেতিবাচক নানা কথা উঠেছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দাবি চুক্তিতে বাস চালানোর প্রমাণ পাওয়ায় বেশ ক’টি পরিবহনকে সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু একে আইওয়াশ বলছেন সাধারণ যাত্রীরাও। অ্যাকশনটি হাসির খোরাকও হয়েছে। কারণ, আকস্মিকভাবে ‘প্রমাণ’ আবিষ্কারের বিষয় নয়।

সড়কে ড্রাইভার, হেলপার ও পথচারীদের নিয়ম অমান্য করার প্রতিযোগিতা মোটেই গোপনীয় ঘটনা নয়। এগুলো চোখের সামনেই ঘটছে। এরপরও পুলিশের দাবি, ট্রাফিক সপ্তাহে জব্বর সুফল এসেছে। কোনো অভিযানের পর পুলিশ এ রকম দাবিই করে। নইলে অভিযান নিরর্থক হয়ে যায়।

আবার পরিবহন রাজ্যের ওস্তাদ-সাগরেদরাও একেবারে সমঝে গেলে তারা হয়ে যায় ভ্যালুলেস। মানুষ তাদের কমজুরি ভাবতে পারে। কমে যেতে পারে শাজাহান খানের জৌলুসও। তিনি তাদের কাছে মুর্শিদ কেবলা তুল্য। খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, বিএনপির মির্জা আব্বাস, জিএম সিরাজ, কফিল উদ্দীন, আওয়ামী লীগের আলহাজ মকবুল হোসেন, রায় রমেশচন্দ্র, সিপিবির মনজুরুল আহসান খানরা এভাবে তাদের এভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয়, নিরাপত্তা দেননি। দিতে পারেননি।

যার ফলে সিটিং, ডাইরেক্ট, নন-স্টপ, গেটলক ইত্যাদি নামে দানবীয় ক্রিয়া-কর্ম বন্ধ রাখা তাদের হিম্মতের জন্য বেমানান। অনিয়ম, নৈরাজ্যসহ ডেমকেয়ার ভাবই তাদের সৌন্দর্যের অংশ। এছাড়া, শাজাহান খানকে তারা একেবারে খামাখা মান্যগণ্য করেন না তারা। এর পেছনে নির্ভরতা ও পাল্টা সুবিধার কিছু বিষয়-আসয়ও রয়েছে। তার হিম্মত, শান-মান, সাম্রাজ্য অঁটুট রাখা তাদের নৈতিকতাভুক্ত। ঈমানি দায়িত্ব।

বাংলাদেশের পরিবহন রাজ্যে শাজাহান খানের হুকুমত একদিনে কায়েম হয়নি। এর পেছনে তাকেও মাজেজা দেখাতে হয়েছে ভক্তকূলের কাছে। তিনি বিপদে-আপদে তাদের যেভাবে পানাহ-শাপাহ দিয়ে রেখেছেন আজতক অন্যরা তা পারেননি। নানান গুণ ও ক্যারিশমাতেই তিনি শাজাহান খান।

তার বিরুদ্ধে লাখ-লাখ, কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগকে অপরাধ মনে করেন না তারা। বরং তার ভাগে-জোগে খাওয়া এবং খাওয়ানোর সুনাম রয়েছে। এটা তার অনন্য গুণ। মন্ত্রী হিসেবে তিনি নৌ-সেক্টরের দায়িত্বে থাকলেও সড়ক পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণে অনেক অবদান রাখেন। আবার জাসদ হয়ে তিনি গত বছর কয়েক আওয়ামী লীগ করলেও কড়া-মিঠা সম্পর্ক রাখেন অন্যদের সঙ্গেও। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাম-আধা বামদের অনেকে খানের সঙ্গে মিলমিশে টিকে থাকতে মরিয়া। এককাট্টা।

শাজাহান খানের কাউকে নাখোশ না রাখার উদাহরণ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। তার নেতৃত্বাধীন পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের সংগঠনটিতে তিনি ভালো পজিশন দিয়ে রেখেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাগ্নে, প্রতিমন্ত্রী মশিউর মশিউর রহমান রাঙ্গাকে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার খাস সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও তার সঙ্গী এবং অত্যন্ত বিশ্বাসী।

সঙ্গে রেখেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ নেতা ওসমান আলীকেও রেখেছেন । আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপির মফিজুল হক বেবুও রয়েছেন খান সাহেবের মুরিদ হিসেবে। শুধু কেন্দ্রে নয়, সারাদেশেই বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের লোকাল প্রভাবশালীরা শাজাহান খানের শীষ্য হিসেবে থাকতে পেরে লাভবান।

মুরিদানদের অকুণ্ঠ সমর্থন-সহযোগিতায় দেশের সড়ক পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন খবরদারিতে শাজাহান খানের ফেডারেশনের দাপট এখন আরো আন-প্যারালাল। প্রভাব ও চাঁদাসহ স্বার্থগত কিছু কারণে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন স্থানে তাদের মধ্যে সংঘাত, টুকটাক খুনাখুনি হলেও মধ্যমনি হিসেবে ওস্তাদি ক্যারিশমায় তিনি যেভাবে দ্রুত ল্যাঠা চুকিয়ে দেন অন্যরা অন্যরা এমনটি পরেননি। ভবিষ্যতে পারবেন-সেই গ্যারান্টিও আপাতত দেখছেন না তারা।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর