বিশেষ প্রতিবেদন

সড়ক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ব্যর্থতা আছে

লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, এমপি। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সাবেক মন্ত্রী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সরকারের অবস্থান নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় গুরুত্ব পায় রাজনীতি, নির্বাচন প্রসঙ্গেও। মতামত ব্যক্ত করেন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে।

Advertisement

আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন ফজলুল হক শাওন ও সায়েম সাবু। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। জাগো নিউজ : কিশোর আন্দোলন এখন রাজনৈতিক আলোচনায়। অনেকেই এই আন্দোলনের ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট। অনেকেই আবার ভিন্ন চোখে দেখছেন। আপনি কীভাবে দেখলেন?

মুহাম্মদ ফারুক খান : ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব আন্দোলন মানুষের কল্যাণের জন্য হয়েছে, তার গতি কিন্তু থেমে থেকেনি, সফল হয়েছে।

Advertisement

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনও জনগণের কল্যাণে নিহিত ছিল বলে সবার সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের পর যখন এই আন্দোলনে রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ চলে আসলো, তখনই কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ে। কোটাবিরোধী আন্দোলনও রাজনীতির বাসাতে বিতর্কিত হলো।

তেমনি কিশোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও রাজনীতির কারণে সমালোচিত হচ্ছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে, সড়কে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এই অব্যবস্থাপনার জন্য ভিআইপি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নাগরিকই দায়ী।

জাগো নিউজ : দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। এভাবে কিন্তু মানুষ মাঠে নামেনি?

ফারুক খান : তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরও আন্দোলন হয়েছে। মানুষ প্রতিবাদ করছে প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই।

Advertisement

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ নতুন গাড়ি নামছে সড়কে। সড়কে উন্নয়নের চাপ পড়েছে, এটি তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই চাপ মোকাবিলার সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি এখনও।

জাগো নিউজ : তাহলে সক্ষমতার অভাবেই সড়কে বিশৃঙ্খলা?

ফারুক খান : হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। ৩৫ লাখ পরিবহন চলছে সড়কে। ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে ২০ লাখ। বাকি ১৫ লাখ ড্রাইভারের অনেকেই দক্ষ। কিন্তু তাদের লাইসেন্স দেয়ার মতো সক্ষমতা নেই।

১৯৮৩ সালে আমি আমেরিকায় পড়ালেখা করা অবস্থায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাই। অত্যন্ত সিস্টেমেটিকভাবে তারা লাইসেন্স দিলো। পরীক্ষা, প্রাকটিক্যাল সবকিছুই সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে হলো। অভিজ্ঞতা দেখেই তারা লাইসেন্স দেয়।

জাগো নিউজ : ১৯৮৩ সালের কথা বলছেন। ২০১৮ সালেও বাংলাদেশ সিস্টেমের মধ্যে আসতে পারলো না…

ফারুক খান : হ্যাঁ, আমরা সিস্টেমে আসতে পারিনি। সড়ক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ব্যর্থতা আছে এবং এই ব্যর্থতা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

জাগো নিউজ : তাহলে কি এই ব্যর্থতা থেকে অনাস্থা জ্ঞাপন করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলো?

ফারুক খান : এমন অভিযোগ ঠিক নয়। তবে সার্বিক বিচারে আমি মনে করি, সড়ক ব্যবস্থাপনায় আমাদের অনেক উন্নয়ন দরকার।

দোষ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। রেষারেষি করে সমস্যা বাড়ে। সমাধান হয় না। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আওয়ামী লীগ যে কাজ করেছে, তা অন্য কোনো সরকার করেনি। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের সড়ক এখন ভালো। প্রশস্ত হচ্ছে। মানুষ লাইসেন্সও পাচ্ছে।

তবে আরও উদ্যোগ নেয়ার দাবি রাখি। কোনো সরকারের সঙ্গে তুলনা করে বলছি না। জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক ব্যবস্থাপনার ঘাটতি দূর করা দরকার। সমাধান বের করতে হবে। সমস্যা এখনও অনেক। এর প্রমাণ হচ্ছে প্রতি বছর ছয় থেকে আট হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও তাই দেখিয়ে দিলো। ভিআইপিরাও আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, তা বুঝিয়ে দিলো।

ট্রাফিক সমস্যার সমাধান জরুরি। আমি মনে করি, লাইসেন্স সেক্টর বেসরকারি খাতে দেয়া উচিত। উপজেলা থেকেও লাইসেন্স দেয়া হোক। বিআরটিএ একা সামলাতে পারছে না।

জাগো নিউজ : লাইসেন্স সমস্যাকেই বড় করে দেখা হচ্ছে। পুলিশের চাঁদাবাজিসহ সড়কে নানা সমস্যা আছে। যানজটও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ…

ফারুক খান : ব্লেইম করে আসলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নিজ নিজ জায়গা থেকে আমরা সবাই যদি সচেতন বা সতর্ক হই তাহলে সংকট অনেক কমে যাবে। চাঁদা নেয়ার সুযোগ পায় ব্যক্তির ত্রুটির কারণে। পুলিশের কি দায়, তাও ভুলে যায় পুলিশ! দেশটা সবার। দায়ও সবার।

জাগো নিউজ : শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন থেকে রাষ্ট্র কী পেলো?

ফারুক খান : সড়ক ব্যবস্থাপনায় আমরা এখনও অনেক পেছনে আছি, এটিই রাষ্ট্র অনুধাবন করতে পারলো। এই ব্যবস্থাপনার দ্রুত উন্নয়ন দরকার। দ্বিতীয়ত, আইনের দুর্বলতা কাটিয়ে যুগোপযোগী আইন করা সময়ের দাবি। সর্বশেষ আমি মনে করি, সার্বিক ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন করতে হবে।

এই আন্দোলনের ফলে সড়ক নিরাপত্তা আইন দ্রুত মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। দোষীদের শাস্তির বিধান বাড়ানো হয়েছে। বিআরটিএ-কে সক্রিয় করতে তাগিদ দেয়া হয়েছে।

জাগো নিউজ : আপনি কি মনে করেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যে অসঙ্গতি তার জন্য এই আন্দোলন একটি ধাক্কা?

ফারুক খান : অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যে ত্রুটি আছে, তা দেখিয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। সড়কে অব্যবস্থাপনা দূর করতে প্রধানমন্ত্রী তাগিদ দিয়েছেন। মন্ত্রীরা বলছেন অসঙ্গতির কথা। পুলিশও স্বীকার করেছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও সড়কের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন এবং এটি বলছেন, শিক্ষার্থীরা মাঠে নামার পরই।

জাগো নিউজ : শিক্ষার্থীরা ন্যায্য অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছিল। সমর্থন দিয়েছিলেন আপনারাও। কিন্তু সপ্তাহ না গড়াতেই রাজনৈতিক বিতর্কে চাপা পড়লো আন্দোলন। অভিযোগ আওয়ামী লীগের দিকেও…

ফারুক খান : কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ইস্যু করে বিএনপি-জামায়াত ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছিল। এ কারণে আন্দোলন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সড়কে কীভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, তাই শিক্ষার্থীরা নানাভাবে দেখাচ্ছিল। প্রথম তিন কি চারদিন ছিল শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। পাঁচদিনের মাথায় বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইলো। বিএনপি নেতার ফোনালাপ তো শুনেছেন।

গুজব রটানো হলো। একজন অভিনেত্রীও এই গুজবে ধরা পড়লেন। একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো বিএনপি-জামায়াত। ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম তার অপরাধের কথা নিজেই স্বীকার করেছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে বিদেশে কোনো গুজব রটেনি। শহিদুল আলম আটক হওয়ার পরই বিদেশিদের কাছে নানা খবর প্রোপাগান্ডা হিসেবে যেতে থাকলো।

জাগো নিউজ : ষড়যন্ত্র বা গুজবে বিএনপি-জামায়াতের যারা জড়িত বলে মনে করছেন, সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? অথচ শহিদুল আলমকে আটক করে রিমান্ডও দেয়া হলো…

ফারুক খান : ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছে। দ্রুতই অ্যাকশন দেখতে পাবেন।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি