হিমাচলে ঘুরতে গিয়ে মারাত্মক তুষার ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন কলকাতার বাসিন্দা গোপা কর। একদিকে রোমাঞ্চকর হলেও অন্যদিকে ভয়ংকর ছিল সে ঝড়। ভ্রমণ করতে গিয়ে এমন আতঙ্কে সময় কাটাতে হয়নি কখনো। সেই অভিজ্ঞতাই জানাচ্ছেন আজ প্রথম পর্বে-
Advertisement
সালটা ২০০৯। মে মাসের এক সন্ধ্যায় বোনের এক ফোনেই ঠিক হলো- এবারের পূজায় আমরা যাব হিমাচলের কিন্নর কল্পা। আমরা অর্থাৎ আমি, আমার মেয়ে ও আমার স্বামী এবং আমার বোন। সেইমতো সব ব্যবস্থাপনা হলো। কিন্তু শেষমুহূর্তে রাজধানী এক্সপ্রেসে বোনের টিকিট কনফার্ম না হওয়ায় ওকে বিমানের টিকিট কাটতে হলো। মহাষষ্ঠীর দিন প্রবল বর্ষণ ও তুমুল বজ্রপাতের মধ্যে রাজধানী এক্সপ্রেসে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। তখনো বুঝিনি এই দুর্যোগ, আমাদের ভ্রমণের শেষপর্যায়ে আরও বেশি দুর্ভোগের ইঙ্গিত। পরদিন দিল্লি থেকে যাত্রা শুরু করে আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য ছিল হরিয়ানার পাঁচকুলা জেলার পিঞ্জর গার্ডেন। সপ্তদশ শতকে তৈরি পিঞ্জর শহরের এই বাগান দেখে মন ভরে গেল। এরপরই হিমাচলের প্রবেশ দ্বার। সিমলার কিছু আগে এইচপি ট্যুরিজমের একটি গেস্ট হাউসে কাটল প্রথম রাত।
পরবর্তী গন্তব্য সারাহানে যাওয়ার জন্য পরদিন সকাল ৮টায় রওনা হলাম। চেল, ফাগু পেরিয়ে পথে আট্টুপিকে আট্টু মাতার মন্দির দেখে এগিয়ে চললাম। পথে পড়ল ছোট্ট পাহাড়ি শহর রামপুর। রাস্তার উপরেই পড়ল বুশাহার রাজাদের আমলে তৈরি প্রাসাদ, পদম প্যালেস। মনমুগ্ধকর স্থাপত্য। রামপুরে মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতির পর আবার যাত্রা করলাম। জিওরি হয়ে সারাহান পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বরফাবৃত শ্রীখণ্ড পর্বত দিয়ে ঘেরা সারাহানের প্রাকৃতিক দৃশ্য এককথায় অপূর্ব। পরদিন দেখলাম ভীমাকালি মন্দির। বুশাহার রাজাদের আমলে তৈরি এ কাঠের মন্দিরের অপূর্ব কারুকাজ দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। সময়টা নওরাত্রি ছিল বলে মন্দির চত্বর ছিল পর্যটক ও পূণ্যার্থীতে পরিপূর্ণ। মন্দিরের উল্টোদিকেই বুশাহার রাজাদের প্রাচীন রাজবাড়ি। মনকাড়া স্থাপত্য। মন্দির, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি দেখে সকাল ১০টায় রওনা হলাম সারাহান থেকে ৯৭ কিমি দূরে কল্পার উদ্দেশে।
> আরও পড়ুন- কলকাতায় ট্রাম ভ্রমণে একদিন
Advertisement
একের পর এক পেরিয়ে গেলাম টাপরি, করছাম, ওয়াংটু ইত্যাদি স্থান। এই পুরো রাস্তায় শতদ্রু নদী সঙ্গী হয়ে রইল। করছামে শতদ্রু নদী পার হওয়ার পর বিপরীত দিকে দুটি রাস্তার একদিকে কল্পা ও অন্যদিকে সাংলার অবস্থান। পাহাড় কেটে তৈরি ভয়ংকর সুন্দর রাস্তা পেরিয়ে প্রায় তিনটা নাগাদ পৌঁছলাম কল্পার সদর শহর রেকংপিও। চতুর্দিকে পাহাড়ের মাঝখানে ছোট্ট শহরটির অবস্থান এককথায় অপূর্ব। রেকংপিও থেকে মিনিট দশেই পৌঁছে গেলাম কল্পা। চতুর্দিকে ফলভর্তি আপেল গাছ দেখে বাক্যহারা আমি। গোল্ডেন আপেল কথাটি এতদিন শুধু শুনেছি। আজ চোখে দেখে বিস্মিত হলাম। শুনলাম দেখতে কচিকলাপাতা রঙের হলেও পেকে যাওয়ার পর সত্যিই সোনার মতো রং হয়। সেদিনই বাগানে গিয়ে লাল, সবুজ মিলিয়ে দু’ পেটি আপেল কেনা হলো। পরদিনের দ্রষ্টব্য ছিল চিনি গ্রাম ও রোঘি গ্রাম। বিকেলবেলা কিন্নর কৈলাসে অস্তগামী সূর্যের রঙের খেলা দেখে আপ্লুত হলাম।
অপরূপ কল্পাকে বিদায় জানিয়ে পরদিন রওনা হলাম ৩৯ কিমি দূরে পরবর্তী গন্তব্য সাংলার উদ্দেশে। পরিকল্পনামত প্রথমে সাংলায় না থেমে চলে গেলাম সাংলা থেকে ২৬ কিমি দূরে ভারত-তিব্বত সীমান্তের শেষ গ্রাম ছিটকূলে। ছিটকূল পৌঁছনোর আগে ঘন পাইন বন, অসংখ্য বোল্ডার ও খরস্রোতা বসপা নদীর মিলিত ল্যান্ডস্কেপ রকছাম দেখে উদ্বেলিত আমরা। বসপা নদীর তীরে শ’দুয়েক গ্রামবাসী নিয়ে ছিটকূল গ্রাম। অপূর্ব এর অবস্থান। গ্রামের বিদ্যালয়টি বসপা নদীর তীরেই অবস্থিত। সেখানে ছিটকূল গ্রামের খুদেরা ব্যস্ত ছিল খেলাধুলায়, সম্ভবত টিফিন পিরিয়ড ছিল। গ্রামবাসী ব্যস্ত ছিল কাজে। পাহাড়ি ঝোরার জলে মহিলারা ব্যস্ত ছিলেন গৃহস্থালীর কাজে। কিছু বয়স্ক মহিলা রোদে বসে গল্প করছিলেন। ছিটকূলে আমাদের থাকার পরিকল্পনা না থাকায় কিছুটা সময় নদীর ধারে ও কিছুটা সময় গ্রামের ভেতরে ঘুরে ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে, অপরূপ কাঠের কাজ করা মা দুর্গার মন্দির দেখে রওনা দিলাম সাংলার পথে। সন্ধ্যাবেলা পৌঁছলাম। হাজার বছরের প্রাচীন কামরু দূর্গ শুধু অদেখা রয়ে গেল আমাদের।
পরবর্তী গন্তব্য জিবি। সাংলা থেকে সকাল ৯টায় রওনা হয়ে পুনরায় করছাম ড্যাম, অট পার হয়ে এলাম ৩১২০ মিটার উচ্চতার জলোরি পাস। জলোরি পাসের রাস্তাটি একটু চড়াই এবং বিপদসংকুল। উপর্যপরি রাস্তার অধিকাংশ অংশই পিচবিহীন, মাটির। সত্যি বলতে- একটু যেন ভয়ই করছিল ওই অঞ্চলটি পার হতে। রাস্তার পার্শ্ববর্তী সাইনবোর্ডে সতর্কতামূলক বার্তা হিসেবে লেখা ছিল, ‘গাড়ি যেন ফার্স্ট গিয়ারেই চালানো হয়।’ বিকেল তিনটা বেজে গেল জিবি পৌঁছতে।
> আরও পড়ুন- সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য উপেন্দ্র সরোবর!
Advertisement
জিবি একটু অচেনা জায়গা। পর্যটকের ভিড় এখানে নেই বললেই চলে। সে অর্থে কোনো হোটেলও নেই। বিস্তৃত উঠোন সমেত দু’তিন কামরার কিছু কটেজ। মালিক ও কর্মচারী মিলে দু’জন এটা চালায়। সেখানে রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধুনী-কাম-কর্মচারীর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করা যায়। আবার রাতের আহার করা হয় মালিকের সঙ্গে একসাথে বসে। খেতে বসার জায়গাটিও বেশ অন্যরকম। মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে জাপানের টি-টেবিলের মতো টেবিলে খাওয়ার আয়োজন। একরাত জিবি কাটানোর পর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আরেকটি দিনও থেকে যাই। অপূর্ব প্রকৃতি। কটেজ মালিক ললিত পৌঁছানোর দিন সন্ধ্যাবেলা সামান্য কিছু দূরে ট্রেকিংয়ে নিয়ে গেল ঘন অরণ্যের মধ্যে একটি ঝরনা দেখাতে। বেশ রোমাঞ্চকর যাত্রা। ললিতের ইচ্ছে ছিল- আমরা আর একদিন থেকে গেলে, ও আমাদের নিয়ে যাবে একদিনের ট্রেকিংয়ে। কাছাকাছি বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুট আছে। যা বিদেশি পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তীর্থণ ভ্যালি, চৈনি গ্রামের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আমাদের হোটেল বুক করা ছিল মানালিতে। আবার আসব কথা দিয়ে পরদিন সকাল ন’টায় রওনা হলাম মানালির উদ্দেশে।
জিবি থেকে মানালি যাওয়ার পথে কুলু ভ্যালির অন্যতম একটি স্থান রামলীলা ময়দান পড়বে, এটা আমার জানা ছিল। যেখানে দশেরা উৎসবে প্রচুর পর্যটক সমাগম হয়। ইচ্ছে ছিল দশেরার সময় অঞ্চলটি দেখার। কিন্তু ড্রাইভার অশোক ভাই একটি বাইপাস রাস্তা দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল। দূর থেকে রামলীলা ময়দান দেখে কুলু ভ্যালি পার হয়ে গেলাম। এরপর একে একে জগৎসুখ, নাগগর পার হয়ে পৌঁছলাম মানালি। নাগগরের কাঠের রাজপ্রাসাদ (যা এখন বিলাসবহুল হোটেল) দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি। মুগ্ধ করেছে রুশ চিত্রশিল্পী নিকোলাস রোয়েরিখের পেন্টিং নিয়ে তৈরি ‘রোয়েরিখ আর্ট গ্যালারি’।
মানালি যখন পৌঁছলাম; সূর্যদেব তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছেন। মানালিতে আমাদের দু’দিন থাকার কথা। মেয়ে আর বোনের অদেখা রোটাং পাস দেখতে পরের দিন সকাল সকাল রোটাং যাত্রা স্থির হলো। আমাদের সারথি গাড়ি পার্ক করার আগে আমাদের উদ্দেশে বলল, ‘দিদি কাল বহুত সুবে সুবে নিকালনা পড়েগা। নেহিতো রোটাং যানে কে রাস্তে মে বহুত জ্যাম হো যায়গা।’
যথাসময়ে রওনা হলাম রোটাং পাসের উদ্দেশে। মানালি শহর ছাড়িয়ে গাড়ি কিছুদূর এগোনোর পরেই হঠাৎ দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল ছাউনি মতো একটি জায়গায়; যেখানে বরফের উপযুক্ত পোশাক ভাড়া দেওয়া হয়। আমি একটু বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে বললাম, ‘এখানে থামালে কেন?’ উত্তর এলো, ‘এগুলো নিলে সুবিধে হবে।’ আমি মনে মনে ভাবছি, ‘সুবিধে আমাদের কিছুই হবে না। কারণ এইসময় মোটেই বরফ পড়ে না। নিজের কমিশনের জন্যই আমাদের দিয়ে এগুলো ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।’ কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না। ওই সময়ে বিনাকারণে বরফের পোশাক আর জুতো পড়ে খুবই রাগ হচ্ছিল।
> আরও পড়ুন- মন হারায় ধরন্তির ঘোলা জলে
গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। এবার ড্রাইভারের পাশে বসলেন একজন গাইড, আমাদের রোটাং পাস দেখানোর জন্য। আবারও রাগ হলো- এর আগে আমরা নিজেরাই রোটাং ঘুরে এসেছি কোনো গাইড ছাড়া। ব্যাবসা কাকে বলে? গাড়ি ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। একটু বাদেই মনে হলো নীল আকাশ ক্রমশ ছাই রং হয়ে যাচ্ছে। ছাই রং ক্রমশ গাঢ় হতে শুরু করল। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনছি, ‘এ বাবা বৃষ্টি হবে নাকি?’ ওদিকে আমাদের অশোক ভাই উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘দিদি আপলোগ বহুত লাকি হো, আজ তো জরুর বরফ গিরেগি।’
সকাল ৯টা নাগাদ মারহি পৌঁছানোর পর ব্রেকফাস্ট সারা হলো নুডলস দিয়ে। খাওয়ার মাঝেই বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝিরঝির করে পেঁজা তুলার মতো বরফ পড়ছে। মনটা খুশিতে নেচে ঊঠল। বুঝলাম আমাদের সারথি সঠিক কথাই বলেছিল। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠলাম। সবার আগে রোটাং পৌঁছতে হবে!
গাড়ি চলতে লাগল, সঙ্গে তুষারপাতও। রোটাং পৌঁছানোর পর তুষারপাতের পরিমাণ বেড়ে গেল। মহানন্দে সবাই গাড়ি থেকে নেমে বরফের বল বানিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলাম। খানিকবাদে মনে হলো, হাওয়া যেন জোরে বইছে। আরো কিছুক্ষণবাদে ওই বাতাস প্রায় কালবৈশাখী ঝড়ের মতো বোধ হলো। সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়ের ধুলোর বদলে তুষার ঝাপটা। কি হচ্ছে ব্যাপারটা বুঝতেই কিছুটা সময় চলে গেল। বরফের ঝাপটা শীত পোশাক ভেদ করে যেন সূঁচের মতো বিঁধতে লাগল। আনন্দ দূরে থাক, দাঁড়িয়ে থাকাই যেন অসম্ভব মনে হলো। সবাই দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে বসলাম। হাওয়ার বেগ আর তুষারপাত উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। অবস্থা সুবিধার নয় বুঝে গাইড ও ড্রাইভার দু’জনেই বলল, ‘দিদি, ফিরে চলুন।’ আমরাও রাজি হয়ে গেলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি আর এগোতে পারল না। তুষারপাতের ফলে রাস্তায় প্রায় একহাঁটু সমান বরফ জমে গেছে। সামনে সারিবদ্ধভাবে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা এগারোটা বাজে।
চলবে...
এসইউ/এমএস