মতামত

সাংবাদিকের ওপর হামলা ও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ সভ্যতা

 

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে মার খেয়েছেন বহু সাংবাদিক। ক্যামেরা ভাংচুর গালাগালসহ নানা ভাবে হয়রান ও অপদস্ত হয়েছেন সাংবাদিক। শিক্ষার্থীরাও পিটিয়েছে সাংবাদিকদের আবার ছাত্রলীগের কর্মীরাও পিটিয়েছে।

Advertisement

সাধারণ শিক্ষার্থী আর ছাত্রলীগ, আন্দোলনের দর্শনে ছিল প্রতিপক্ষ, কিন্তু সাংবাদিক পেটানোর সময় একপক্ষ। এদিকে এই দু’পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে সতর্ক হওয়ার অনুরোধক্রমে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল গণমাধ্যমগুলোকে। খারাপ কী? ভালইতো। শুধু ভাল না, একে বেশ ভাল বলতে চাই আমি।

ঠিক ক’দিন আগে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময়ও সাংবাদিকদের প্রতি বিরুপ হয়েছিলেন আন্দোলনের কর্মীরা। যেখানে কোন ঘটনার দু’টি পক্ষ সেখানেই এরকম হয় এবং নিয়মিত হচ্ছে। এটা অনেকটা ভবিতব্য বলতে পারি আমরা। কিন্তু আমার সাংবাদিক বন্ধুদের অনেকেই এনিয়ে মন খারাপ করেন।

নিজেই নিজেকে অভিসম্পাত করে বলেন “যাচ্ছে তাই একটা পেশায় এসে পড়লাম” এই কাজে ধন্যবাদ বলে কিছু নেই। আমি কখনই এনিয়ে তাদের সঙ্গে গলা মেলাই না। আমার ভালই লাগে। আমি চিন্তা করি, কোন পক্ষই যখন খুশি নয় তাহলে আমার চিন্তা ঠিক আছে।

Advertisement

প্রিয় পাঠক, গত এক সপ্তাহের পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনের আর্কাইভ মিলিয়ে দেখতে পারেন। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কর্মীরা যা বলছেন, তার মধ্যে যতটুকু সাংবাদিকতা আছে আমরা ততটুকুই বলছি। এক মাধ্যমে কোন কারণে কিছু বাদ পড়লে আরো তিনটি মাধ্যমে সেই কথা বলে দিচ্ছে।

তার পরেও তারা খুশি হচ্ছে না। কারণ সাংবাদিকরা আন্দোলনের অংশ হয়ে মিছিলে নামতে পারছে না। পাশাপাশি আন্দোলনের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে সেকথা বলতে হচ্ছে। সেটাকে তারা বিরুদ্ধাচার মনে করছে।

সরকার যা চাইছে না গণমাধ্যমগুলোতে তাও প্রচার হচ্ছে। যে কারণে সরকারও সাংবাদিকের উপর খুশি হচ্ছে না। কিন্তু রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির প্রশ্ন যেখানে উঠছে, সেখানেই আত্মসম্পাদনা করছে গণমাধ্যম। কোন সরকার নিশ্চয়ই এমন কিছুর প্রচার চায় না যা তার বিপক্ষে যায়।

চাইবে, এমন আশা করাও ঠিক নয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তা করেও না। সাংবাদিক যেটা করে সেটা হচ্ছে, যা ঘটনা তাই বলে অথবা লেখে। সেখানে তাঁর ব্যক্তিগত কোন মত থাকে না। তবু সরকার ক্ষুব্ধ হয়।

Advertisement

চাইলেই সরকার বা কোন একক শক্তিশালী পক্ষকে খুশি করতে পারে না সাংবাদিক। কারণ তাঁর কাছে মানুষ মুখ্য। কোন ঘটনায় কত “মানুষ জড়িত” এরকম একটি সূত্র তিনি মানেন। তাই সবসময় তিনি বেশিরভাগ মানুষের মত প্রচার করতে চান। কারণ তিনি যে মাধ্যমটিতে কাজ করেন সেই মাধ্যমটির শুরুতেই “গণ” ব্যাপারটি আছে। তাঁকে মানুষের সঙ্গে থাকতে হয়।

ইনিয়ে বিনিয়ে এত কথা বললাম, কারণ সাংবাদিকের কাজ কাউকে খুশি করা নয়। যা ঘটনা তাই বলা। একটি ঘটনার যথন দু’টো পক্ষ থাকে তখন কেউ লাভবান আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেনই। রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজ বদল নয় খুব সহজ করে একটা উদাহরণ দিতে পারি।

ধরা যাক একটি এলাকায় চুরি বেড়েছে। সাংবাদিক এটা নিয়ে একটা প্রতিবেদন করলেন। এতে পুলিশি টহল বাড়লো। রাস্তায় আলো দেয়া হলো। এলাকায় চুরি থামলো। খুশি হলেন বিশাল এলাকাবাসী। কিন্তু সীমিত চোর শ্রেণির কথা চিন্তা করেন। তারা কিন্তু সাংবাদিকের ওপর খুশি হতে পারলো না।

এখন আমাকে বলতেই হচ্ছে সাংবাদিক চাইলেও শতভাগ মানুষকে খুশি করতে পারবেন না। তাঁর কাজ বেশিরভাগ মানুষের পাওয়া না পাওয়া, ভাল থাকা, খারাপ থাকা নিয়ে। এখানো সে কারো পক্ষ নিয়ে ফেললে বা কোন পক্ষের সঙ্গে নিজে মিশে গেলে, সেটা আর যাই হোক সাংবাদিকতা হবে না।

যে কারণে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, যত ঝড় আসুক সাংবাদিককে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার একই সময়ে তিনি মানুষ হিসেবে কোন পক্ষের প্রতি তিনি দুর্বল হয়ে যান। কিন্তু সেই দুর্বলতার প্রভাব কাজের ওপর ফেলেতে পারেন না। এর জন্যে কখনো কখনো নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ বাঁধে। কিন্তু সেই যুদ্ধে কখনই তিনি জেতেন না।

পাঠক, আমি আসলে সাংবাদিকের নানা অসহায়ত্বের কথা বলার চেষ্টা করলাম। এত অসহায়ত্বের মধ্যেও মার খাচ্ছে এই পেশাজীবী শ্রেণি। প্রতিদিন আমাদের কাছে নানা এলাকা থেকে সাংবাদিকের ওপর হামলার খবর আসে। মারাও যান কেউ কেউ।

হামলার যত খবর আসে প্রতিদিন তার সবগুলো হয়তো প্রচার বা প্রকাশ করতে পারি না আমরা। কিন্তু একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি এই হামলাগুলো আসলে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটি হামলা আরেকটি হামলার রেশ। প্রথমটি না হলে দ্বিতীয়টি হতো না।

হত্যার প্রসঙ্গ যখন আসলো তখন মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু, শামসুর রহমানসহ কেবল দীর্ঘ লাশের মিছিল দেখবো আমাদের সামনে। যার কোনটির বিচার হয়নি। মিছিল মিটিং কর্মবিরতি কী করতে হয়নি সাংবাদিকদের। তার পরেও একটি হত্যারও সুষ্ঠু বিচার হয়নি।

এই বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির সঙ্গেই জড়িত আজকের খবর পছন্দ না হলেই সাংবাদিকের ওপর হামলার বিষয়টি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিকঠাক নিজের কাজ করার অপরাধে একটি শ্রেণি কি এভাবে মার খেতেই থাকবে? যদিও এই প্রশ্ন আজ শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বব্যাপী।

অল্প যে কয়টি বিষয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে, তার মধ্যে ‘সাংবাদিক নির্যাতন’ আছে। অথচ বিশ্বব্যাপী কোন দেশের উন্নয়নের মান নির্ধারণের যত সূচক রয়েছে তার মধ্যে, মুক্ত গণমাধ্যমের চর্চা অন্যতম। যে কোন সভ্য দেশে সাংবাদিক নিজের মত করে নির্ভয়ে যেকোন খবর প্রচার করতে পারেন। আর নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে দেশের গণমাধ্যম পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ভোগ করে সেদেশে দুর্ভিক্ষ হয় না।

লেখক : সাংবাদিক। palash_ahasan2003@yahoo.com

এইচআর/এমএস