সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ দর্শন

দর্শন ও সাহিত্যের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনায় আসার পর, কেউ যদি সাহিত্যকে দর্শনের ভান্ডার হিসেবে অস্বীকার করতে চান কিংবা দর্শনকে সাহিত্যের অলংকার বা শক্ত মেরুদণ্ড হিসেবে মেনে নিতে না-ও চান, তবুও রবীন্দ্রসাহিত্যে দর্শনের নিগূঢ় তত্ত্বকে স্বীকার করতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্যের জন্য সাহিত্যচর্চা করে যাননি বরং সমসাময়িক নানান সমস্যাকে তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তার উপজীব্য করেছিলেন। যেগুলোর উপস্থাপন শৈলী যথারীতি দার্শনিক ভঙ্গিমায় ছিল। পার্থিব-অপার্থিব, বাস্তব-কাল্পনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশসহ বিস্তর বিষয়ে তাঁর রচিত বিভিন্ন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রয়েছে। আমি এই প্রবন্ধে কেবল তাঁর পরিবেশ বিষয়ক ভাবনা বা দর্শনকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

Advertisement

পরিবেশ বিষয়ক সমস্যা এবং এ বিষয়ে আলোচনা বর্তমান সময়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানাবিধ কারণে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলস্বরূপ আমরা জানতে পেরেছি, মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে বিশ্বজুড়েই পরিবেশ মানুষ এবং প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যে জন্য গবেষকরা বেশি দায়ী করছেন উন্নত দেশগুলোকে, যারা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে যাচ্ছে-তাইভাবে পরিবেশের উপর আধিপত্য দেখাচ্ছে। যার কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। আর এর পেছনে মানুষের অরাজকতা, অসচেতনতা এবং লোভই সর্বাংশে দায়ী। সাম্প্রতিক গবেষণার এ গুরুত্ববহ বিষয়টি অর্থাৎ পরিবেশ ভাবনা বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় অনেক আগেই লক্ষ্য করা গেছে।

তিনি প্রকৃতির যথার্থতা রক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন উপলব্ধি ছিলো বলেই তিনি ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে এমন মন্তব্য করেছেন, মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্য সম্পদকে রক্ষা করাই সর্বত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিধাতা পাঠিয়েছিলেন প্রাণকে, চারিদিকে তারই আয়োজন করে রেখেছিলেন। মানুষই নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ জুগিয়েছে। মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছের উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই ধ্বংস করেছে।

> আরও পড়ুন- রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কথন

Advertisement

আমরা বর্তমানে আসলে কী দেখতে পাচ্ছি? আমাদের এই যে নানাবিধ জটিল রোগ বালাই, পরিবেশের উষ্ণায়ণ, আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যার পেছনে কি আমরাই (মানুষেরা) দায়ী নই? আমাদের লোভই আমাদেরকে পরিবেশের সাথে অন্যায় আচরণ করতে প্রলুব্ধ করছে। এই যেমন, ক্ষতিকর জেনেও বেশি লাভের জন্য আমরাই ফলে, সবজিতে, মাছে এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে দিচ্ছি। কৃষি জমিতে অধিক উৎপাদনের নিমিত্তে কীটনাশক, রাসায়নিক সার প্রয়োগ করছি ইত্যাদি। ফলাফল, আজকের এই পরিবেশের বিপর্যয় বা ভারসাম্যহীনতা। যে বিষয়টি বর্তমানে পরিবেশবিদদের অত্যন্ত মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটিই রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই প্রকৃতিবাদী দর্শনচিন্তার প্রতিফলন রেখে গেছেন বিভিন্ন কাব্যে-সাহিত্যে। তাঁর ‘আত্মশক্তি’ নামক রচনায় নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, ‘আমরা লোভবশত প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার যেন না করি। আমাদের ধর্মে-কর্মে, ভাবে-ভঙ্গিতে প্রত্যহই তাহা করিতেছি, এই জন্য আমাদের সমস্যা উত্তরোত্তর হইয়া উঠিয়াছে- আমরা কেবলই অকৃতকার্য এবং ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িতেছি। বস্তুত জটিলতা আমাদের দেশের ধর্ম নহে। উপকরণের বিরলতা, জীবনযাত্রার সরলতা আমাদের দেশের নিজস্ব। এখানেই আমাদের বল, আমাদের প্রাণ, আমাদের প্রতিজ্ঞা।’

রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় প্রকৃতির অপরূপ রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘নম নম নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!/ গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।/ অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি-/ ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।/ পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ-/ স্তব্ধ অতল দিঘী কালোজল নিশীথশীতল স্নেহ।/ বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে/ মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।’ তিনি এখানে কেবল প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করেছেন, আমরা যদি কেবল এতটুকু উপলব্ধি করি- তবে তা অপর্যাপ্ত থেকে যাবে এজন্য যে, তিনি এখানে প্রকৃতির রূপ বর্ণনার পাশাপাশি প্রকৃতিকে মায়ের সাথে তুলনা করেছেন। যার মাধ্যমে আসলে তিনি প্রকৃতির মর্যাদা বা গুরুত্বকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি তাঁর ‘বৃক্ষ’ নামক কবিতায় মানুষকে নয় বরং বৃক্ষকেই ‘মৃত্তিকার বীর সন্তান’ এবং ‘আদিপ্রাণের’ স্বীকৃতি দিয়েছেন।

পৃথিবী ব্যাপী এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। কার্বন নিঃসরণ, পারমাণবিক ও তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণ মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। আমরা প্রতিনিয়তই হা-পিত্যেশ করতে থাকি আমাদের নগর জীবন নিয়ে। যে উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথ আগেই করে বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ তাছাড়া তিনি প্রকৃতির সমন্বয় ও ঐক্যের পক্ষে ছিলেন বলেই শহরকে উদ্দেশ্য করে বলতে পেরেছিলেন, ‘ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট, নেইকো স্নেহ, নেইকো ভালোবাসা।’ একইসঙ্গে গ্রামকে নিয়েও বলেছিলেন, ‘আমার যে নিরন্তর ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পল্লী গ্রামকে দেখেছি, তাতেই আমার হৃদয়ের দ্বার খুলে দিয়েছে।’

> আরও পড়ুন- অন্যরূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Advertisement

এমনকি রবীন্দ্রনাথ কৃষিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। যার নজির আমরা দেখতে পাই তাঁরই পরিবারে। প্রকৃতির প্রতি গুরুত্ব উপলব্ধি করেই তিনি তাঁর পুত্র, জামাতা এবং বন্ধুপুত্রকে কৃষিবিষয়ে পড়াশোনা করতে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন, যা অনেক রবীন্দ্রগবেষকই উল্লেখ করেছেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা কন্যা মীরার বিবাহের পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকেও বিদেশ পাঠান কৃষিবিদ্যা অর্জনের জন্য। রবীন্দ্রগবেষক আবদুশ শাকুরের মতে, ‘যে যুগে সন্তানদের আই.সি.এস বা ব্যারিস্টার বানানো ধনী বাঙালি পরিবারের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, সে সময় জনৈক ধনী জমিদারের পুত্র, জামাতা আর বন্ধুপুত্রকে চাষাবাদ শিখতে বিদেশ পাঠানোর মতো একটা বিপ্লবাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন রবীন্দনাথের মত একজন দায়বদ্ধ স্বদেশভাবুকের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল।’

তাছাড়া তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের দিকে দৃষ্টি দিলেই তাঁর পরিবেশবাদী চিন্তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায়। যেখানে তিনি গাছ, মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে পড়াশোনার প্রেমময় পরিবেশে তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে নিজ জন্মদিনের উত্তরায়ণে পঞ্চবটী বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা করেন। যা ঋতু উৎসব হিসেবে ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে বর্তমানে বহু শিক্ষার্থী তাঁদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং কৃষি বিষয়ক নানান তত্ত্ব সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ হচ্ছেন।

রবীন্দ্রসাহিত্যের একটি বিরাট অংশজুড়ে ছিল পরিবেশ বিষয়ক ভাবনা। যেখানে তিনি কেবল পরিবেশকে কাব্যিকভাবে বা উপমা দিয়েই প্রকাশ করেননি বরং পরিবেশ বিষয়ক সমস্যাকেও নানাভাবে তুলে ধরেছেন। প্রকৃতির চিরন্তন রূপ আর তাঁর সাথে প্রকৃতির ন্যায়পরায়ণতার ধারণা প্রতিষ্ঠায় লিখেছেন। এজন্যই আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একজন পরিবেশবাদী দার্শনিক বলতে পারি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এসইউ/পিআর