একবার বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে, এদেশে আর আসব না। পাঁচ বছরের ভোগান্তি কোনো দিন ভুলতে পারব না। যে দেশটি যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছিলাম, সেই দেশ নিয়ে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে ভাবতে পারেনি কোনো দিন। তবে আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। দেখতে চাই আর কত হয়রানির পর আমার গাড়িটি চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগ থেকে ছাড়া পায়। সরকারি কর্মকর্তারা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিজ দেশে আর কত হেনস্তা করতে পারেন। আমার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন এভাবে আমলাতন্ত্রের কাছে পরাজিত হতে পারে না। দুঃখ, বেদনা আর ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন গাড়ি চালিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় অংশগ্রহণকারি যোদ্ধা আবদুস সাত্তার। জাগো নিউজ বার্তাকক্ষে নিজের বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন, প্রতিবদ্ধকতা, দৃঢ়তা আর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা জানাতে এসে তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। আবদুস সাত্তারের বয়স ৬১ চলছে। স্বভাবের বিনয় যেন চেহারার সঙ্গে মিশে গেছে। সদালাপি। রয়েছে তারুণ্য। নেই ক্লান্তি বা বয়সের কোনো ছাপ। চোখে দৃঢ়তার প্রমাণের ঘাটতি নেই। তবে রয়েছে আবেগের ছাপ। আবেগ আর সাহসের কারণেই একাত্তরকে আলিঙ্গন করতে পেরেছিলেন। আর ৫৭ বছর বয়সে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন বিশ্ব ভ্রমণের ।আবদুস সাত্তার সংবাদের অনুষঙ্গ হতে পারতেন। হয়েছেন বটে। তবে কোনো গর্বের কারণ হিসেবে নয়। সংবাদ হয়েছেন বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভুগে। বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন পূরণে বাধার চিত্র হয়ে। ২০০৯ সালের কথা। যখন তার বয়স ৫৭ বছর। সেই বয়সে তিনি বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়েছেন, তাও গাড়ি চালিয়ে। সঙ্গী আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয়, নাম স্যাল বয়। ইতিমধ্যে ২৭টি দেশ পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। ভ্রমণে ভূগোল পরিক্রমার অংশ হিসেবে এসেছেন নিজের প্রিয় দেশ, যে দেশটি অস্ত্র হাতে স্বাধীন করেছেন, সেই সবুজ বাংলাদেশে। কানাডার টরন্টো শহর থেকে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট যাত্রা শুরু করে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড, তারপর ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ ঘুরে তুরস্ক। তারপর ইরান, পাকিস্তান, ভারত হয়ে বাংলাদেশ। কত বিপদ পাড়ি দিয়েছেন এর মধ্যে। তারপর? তারপর, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ভ্রমণ। কত সময়? ৫ বছর ৩ মাস! বিশ্ব ভ্রমণ? সঙ্গী স্যাল বয় ফিরে গেছেন কানাডায়। সাত্তার আটকে গেছেন তাঁর গাড়িটা নিয়ে। শুধু গাড়িও না। কানাডার টরন্টো থেকে সড়কপথে বিশ্বভ্রমণে মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার, ২০০৬ সাল, রেজিস্ট্রেশন-বিবিবিবি ৯৩৫ গাড়িতে বিশ্ব পরিভ্রমণ করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার স্বপ্ন তাঁর। সবই পরিকল্পনামতো চলছিল। পাকিস্তানে পৌঁছে করাচি স্থলবন্দর থেকে তিনি গাড়িটি তুলে দেন কনটেইনারে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়িটি নিয়ে আবার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়া।আবদুস সাত্তার ২০১০ সালের ২৯ মে বাংলাদেশে পৌঁছেন। আর তাঁর স্বপ্ন আটকে গেছে নিজ দেশে। ৫বছর ধরে তাঁর গাড়িটি আটকে আছে চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগে। ছাড় করানোর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। অসংখ্য মন্ত্রণালয়, দফতর, রাজস্ব বিভাগ ও সরকারি বড় কর্তাদের টেবিল থেকে টেবিলে ঘুরেছেন। কিন্তু ফল নেই। ব্যর্থতায় কেবল নীরব কান্নাই সঙ্গী হয়েছে। আমলাতন্ত্রের মন গলেনি।আবদুস সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, এই পাঁচ বছরে আমার হয়রানির কথা বিস্তারিত লিখতে গেলে বিশাল কলেবরের একটি বই হয়ে যাবে। এতোদিনে বিশ্ব ভ্রমণ হয়তো শেষ হতো। অসংখ্য ফিস, আবেদন করেছি। তবে আমলাতন্ত্রের মনে গলেনি। সালাম, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের আমলতন্ত্র। আরেকটি গাড়ি নিয়ে আবার বিশ্বভ্রমণ শুরু করতে পারতেন, জবাবে এই পর্যটক বললেন, আমার লক্ষ্য স্বপ্ন পূরণের মধ্য দিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানো। বাংলাদেশকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তোলা। আর গিনেস বুক রেকর্ডের ক্ষেত্রে তাদের একটি নিজস্ব নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। তা হলো, একই গাড়িতে বিশ্বভ্রমণ। তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রায় এক লাখ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে ২০৫টি দেশ ভ্রমণ করার জন্য আমি বেরিয়েছি।পাঁচ বছরে গাড়িটি তো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এমন আশঙ্কার জবাবে তিনি বলেন, তেমনটা হওয়ার সুযোগ কম। কারণ গাড়িটি একটি স্টিলের কনটেইনারে সিলগালা অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া একদম নতুন গাড়ি।তিনি জানান, গাড়িটি ছাড় করাতে পারলেই আবার বেরিয়ে যাবেন বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন পূরণে। তবে আর ফিরবেন না বাংলাদেশে।জাগো নিউজের ধারাবাহিক আয়োজনে আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব। যেখানে বাংলাদেশে হয়রানির বিশদ ওঠে আসবে। পড়তে চোখ রাখুন...এসএ/এএইচ/এইচআর/আরআইপি
Advertisement