রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। বহিরাগত দালালদের দৌরাত্ব কমলেও জরুরি বিভাগে ভর্তি হওয়া মাত্রই খোদ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নানান ঝামেলায় ফেলে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রোগী ও তাদের স্বজনদের। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে ভর্তি হলেও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে যেতে হলে স্ট্রেচার বাবদ বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে তাদের। ফার্মেসির সামনে টানানো ওষুধের তালিকা দেখেও বোঝার উপায় নেই কি ওষুধ আছে আর কি নেই। এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে রোগ নির্ণয়ের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো। ফলে বাড়তি টাকা দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। আর এরই সুযোগ নিয়ে পকেট ভারি করছে হাসপাতালের আশেপাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো। সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে নির্দিষ্ট ৩০ টাকা দিয়ে ভর্তি হলেও সেখানে দায়িত্বে নিয়োজিত এমএলএসএস কর্মচারীরা স্ট্রেচার বাবদ অতিরিক্ত দেড়শো থেকে দুইশ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছেন রোগীদের কাছ থেকে। ওই পরিমাণ টাকা দিলে তবেই সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে রোগীদের পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। জীবন বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়েই স্ট্রেচার ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অন্যত্র নিতে হলে সেখানেও স্ট্রেচার ভাড়া বাবদ টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অন্যথায় স্ট্রেচার সংকটের অজুহাত দেখিয়ে হয়রানি করা হয় রোগীদের।এদিকে, হাসপাতালে যে ২টি এমআরআই মেশিন রয়েছে তার মধ্যে একটি গত দেড় বছর ধরে এবং অন্যটি গত ৬ মাস ধরে নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে এমআরআই করতে আসা রোগীরা দিগুণ টাকা দিয়ে বাইরে থেকে পরীক্ষা করছেন।অপরদিকে হাসপাতালের ২টি সিটিস্ক্যান মেশিন থাকলেও একটি ৫ বছর ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে। অপরটি বন্ধ থাকার পর গত ১ মাস ধরে চালু করা হলেও ইউপিএস ছাড়াই সরাসরি বৈদ্যুতিক লাইনে চালু করায় যে কোনো মুহূর্তে তা বন্ধ হয়ে যেতে পাড়ে বলে সংশ্লিষ্ট এক চিকিৎসক জানান। এই সিটিস্ক্যান মেশিন দুটি চালু থাকা অবস্থায় জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন রোগীর সিটিস্ক্যান করা হতো। কিন্তু এটিও নষ্ট থাকার কারণে রোগীদের প্রায় ৩ হাজার টাকা খরচ করে বাইরে থেকে সিটিস্ক্যান করে নিতে হচ্ছে।জানতে চাইলে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পীরের মাজার এলাকার আবু তাহেরের স্ত্রী মাজেদা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, তার ছেলে মাজেদুল (১৫) ইসলামের কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে এসে জরুরি বিভাগে স্ট্রেচার বাবদ দেড়শ টাকা দিতে হয়েছে। এছাড়া গত সোমবার হাসপাতালের নতুন ভবন থেকে পুরাতন ভবনের ৩য় তলায় আনতে আরও ২০ টাকা দিতে হয়েছে। হাসপাতালের এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকায় পাশেই একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৭ হাজার টাকা দিয়ে ছেলের এমআরআই করিয়েছেন এবং যাবতীয় ওষুধ বাইরে থেকেই কিনতে হচ্ছে বলেও তিনি জানান।একই অভিযোগ করেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ধুনাগাছ চাপানী এলাকার আনছার আলী। তার চাচা লালু সরকারকে (৭০) বৃহস্পতিবার ভর্তি করাতে এসে স্ট্রেচার নিয়ে ওয়ার্ডে যেতে তাকেও অতিরিক্ত ১৬০ টাকা দিতে হয়েছে। হাসপাতালের রেডিওলোজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের এক চিকিৎসক নাম না প্রকাশ করার শর্তে জাগো নিউজকে জানান, প্রতিদিন এই এমআরআই মেশিন দুটি থেকে জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন রোগীর এমআরআই করা হতো। বাহির থেকে রোগীদের এমআরআই করতে খরচ পড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। মেশিন দুটি নষ্ট থাকায় রোগীদের বাড়তি প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে।হাসপাতালের ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে টানানো ওষুধের তালিকার বেহাল অবস্থা। দেখে বোঝার উপায় নেই ফার্মেসেতে কি ওষুধ আছে আর কি নেই। ফার্মেসিতে ওষুধ নিতে আসা রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফজলে রহমান প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, তার ৬ বছরের ছেলে বায়েজীদ হোসেনকে নিয়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন। ডাক্তার ব্যবস্থাপত্রে ৩টি ওষুধের নাম লিখলেও শুধুমাত্র প্যারাসিটামল হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হবে।হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন দেয়ালে দালালকে ধরিয়ে দিন ও বিনা রশিদে কাউকে টাকা না দেয়ার জন্য সতর্কীকরণ নোটিশ লাগানো হলেও হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ব পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।এ বিষয়ে স্টেনো রুহুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, আগের তুলনায় অনেকটাই দালালমুক্ত হয়েছে হাসপাতাল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দালালদের উপস্থিতি না থাকলেও বিকেলের দিকে দুই একজন দালাল আসেন বলে ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. বিমল কুমার বর্মন জাগো নিউজকে জানান, এমআরআই ও সিটিস্ক্যান মেশিন ভালো করার জন্য একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেন্ট্রাল এসি নষ্ট থাকায় একটি এমআরআই নষ্ট হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ৪/৫ দিনের মধ্যেই সেটি চালু করা সম্ভব হবে।স্ট্রেচার বাবদ টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপাপ্ত পরিচালক বলেন, এভাবে টাকা নেওয়ার কোনো বৈধতা তাদের নেই। তবে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখবেন বলে তিনি জানান।এমএএস/এমএস
Advertisement