বিশেষ প্রতিবেদন

ভোগান্তি বাড়াতে চান শেবাচিমে যান

মাওলা মোগো কির ফান্নে গরীব বানাইছে। গরীব দেইখ্যা মেডিকেলে আইছি। হের পরেও টাক খাইছি। বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া গ্রামের দিনমজুর হানিফ মোল্লার স্ত্রী সালেহা বেগম বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) ওষুধ প্রাপ্তির কাউন্টারের সামনে ক্ষোভ আর আক্ষেপের সুরে তার কষ্টের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন।তবে এসব ভোগান্তির কথা কম বেশি সকলেরই জানা।  প্রতিনিয়ত হাসপাতালে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।  তাই হয়তো তার কথা কেউ কানে নিচ্ছিলেন না।সালেহা বেগম হাসপাতালে এসেছিলেন তার মেয়ে আখিনুর বেগমকে (১১) নিয়ে। আখিনুর কয়েক দিন ধরে তলপেট, কোমড় ও হাটুতে তীব্র ব্যথা অনুভব করছিল। গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিল। তাতে ওষুধ খেয়েও ব্যথা কমেনি।গত বুধবার সকাল ৯টার দিকে ধার করা এক হাজার টাকাসহ আখিনুরকে নিয়ে হাসপাতালের (শেবাচিম) বহির্বিভাগে চিকিৎসা করাতে আসেন।  ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়ানো পর ১১ টাকার টিকেট ১৫ টাকা দিয়ে নিতে হয় তাকে।এরপর আবারো চিকিৎসকের কক্ষের সামনে দীর্ঘলাইন।  এখানেও তার মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় দেড় ঘণ্টা।  অবশেষে মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশের সুযোগ হয় তার।  চিকিৎসক আখিনুরের সমস্যা জানতে চান।এ সময় ডাক্তার সাহেবের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।রিসিভ করে কথা বলা শুরু করেন তিনি।৬ মিনিট পর হঠাৎ মনে পড়ে তার জন্য রোগী অপেক্ষা করছেন।  চিকিৎসক আখিনুরের সমস্যা শুনে আলট্রাসনোগ্রামসহ কয়েকটি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নিয়ে আসতে বলেন সালেহা বেগমকে।  মেডিকেল ভবনের দ্বিতীয় তলার প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে আসিয়া নামে এক মহিলা দালালের খপ্পড়ে পড়েন সালেহা বেগম।আসিয়া নিজেকে হাসপাতালের আয়া পরিচয় দিয়ে সালেহাকে বলেন আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন নষ্ট।তার সাথে গেলে কম টাকায় এসব পরীক্ষা-নীরিক্ষা করিয়ে দিতে পারবেন।  সালেহাকে নিয়ে যাওয়া হলো মেডিকেলের একটু পাশে সুলতানা ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্সে।  সেখানে আখিনুরের সবগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষা করাতে লাগবে ১৩০০ টাকা।তবে আসিয়ার পরিচিত বলে তা কমিয়ে ৯০০ টাকা করা হয়।আখিনুরের রিপোর্ট হাতে পেলেন সালেহা বেগম।ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে দুপুর।  হাসপাতালে গিয়ে দেখলেন ডাক্তার চলে গেছেন। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালে পুনরায় হাজির হলেন সালেহা বেগম।রোগী নয়, রিপোর্ট দেখাবেন।  এজন্য এবার তাকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়নি।  কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ডাক্তার সাহেব ব্যবস্থাপত্রে সিপ্রোফ্লক্সাসিন (৫০০ মিঃলিঃ ) ও প্যারাসিটামল লিখে দিয়ে আখিনুরকে ঠিক মতো ওষুধ খেতে বলেন।ওষুধ প্রাপ্তির কাউন্টারে গিয়ে চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্রটি দেন।  কাউন্টারের ভেতর থেকে বলা হয় সিপ্রোফ্লক্সাসিন (৫০০মিঃলিঃ) ও প্যারাসিটামল এর কোনটার সরবারহই হাসপাতালে নেই।  বাইরে থেকে কিনে নিতে বলেন।তবে সিপ্রোফ্লক্সাসিন (২৫০মিঃলিঃ) তাদের কাছে রয়েছে।সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছ থেকে ৫০০মিঃলিঃ কাটিয়ে ২৫০মিঃলিঃ সিপ্রোফ্লক্সাসিন লেখিয়ে আনতে বলা হয়।সালেহা বেগম ছুটে যান ডাক্তার সাহেবের কাছে।এবার সালেহাকে দেখে বেশ বিরক্ত হলেন, চিকিৎসক।  ডাক্তার সাহেব বললেন লেখা কাটার দরকার নেই।কাউন্টারে গিয়ে তার কথা বলে ওষুধ চাইতে বললেন সালেহাকে।  কাউন্টারে গিয়ে ডাক্তার সাহেবের কথা বলে ওষুধ চাইতে গিয়ে ধমক খেতে হলো সালেহাকে।  কাউন্টারের সামনে থেকে সালেহাকে দুরে সরে যেতে বলা হলো ধমকের সুরে।এত ভোগান্তির পর নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেন না সালেহা বেগম।  এবার আর্তনাদ করে বলে উঠলেন মাওলা মোগো কির ফান্নে গরীব বানাইছে। গরীব দেইখ্যা মেডিকেলে আইছি। হের পরেও টাক খাইছি।আর্তনাদ শুনে এ প্রতিবেদক সালেহা বেগমের কাছে এগিয়ে গেলে উপরোক্ত হয়রানি ও দুর্দশার ঘটনা বর্ণনা করেন তিনি।সালেহা বেগম আরো জানান, দু-দিনে ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র ছাড়া আর কিছুই জোটেনি তাদের ভাগ্যে।এখন ওষুধ কেনা তো দুরের কথা তার কাছে বাড়ি ফেরারও টাকা নেই।বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি গ্রামের রেবিনা বেগম।  চার বছরের শিশু সন্তান রাহাতকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে।  চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে দুই ধরনের ওষুধ লিখেছেন।  কাউন্টারে গিয়ে ১টি ওষুধ পেলেন।  বাকী একটি ওষুধ এ্যাজিথ্রোমাইসিন হাসপাতালে নেই। একই এলাকার ইতি বেগম (২৫) মেয়েলী রোগ নিয়ে ডাক্তার দেখাতে হাসপাতালে এসেছেন। তিনিও অভিযোগ করলেন ৩টির মধ্যে হাসপাতাল থেকে ১টি ওষুধ পেয়েছেন।সদর উপজেলার কড়াপুর এলাকার রানু বেগম (৪৬)।  হাতে ব্যথা নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন হাসপাতালে।  দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট কেটেছেন।  এরপর ফের মেডিসিন বহির্বিভাগের সামনে লাইনে অপেক্ষা করা।  তার সিরিয়াল আসতেই কম্পাউন্ডার বললেন স্যার আর রোগী দেখবেন না।পাশের কক্ষে আরেকজন মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে তাকে যেতে বলেন।কিন্ত সেই চিকিৎসকের কক্ষের সামনেও লাইন।সেখানে অপেক্ষার পর একসময় কক্ষের ভিতরে ঢুকতে সক্ষম হন রানু বেগম।ডাক্তার সাহেব ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত।তার সমস্যার কথা খুব একটা না শুনে তড়িঘরি করে এক কৌটা ভিটামিন ও ব্যথানাশক ট্যাবলেট ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন।এই অবস্থা শুধু সালেহা, রানু বেগম, রেবিনা কিংবা ইতি বেগমের নয়, আধুনিক চিকিৎসার আশা নিয়ে দক্ষিণের এই সর্ববৃহৎ সরকারি হাসপাতালে এসে হোচট খাচ্ছেন সবাই।  এত গেল বহির্বিভাগের রোগীদের কথা।  অন্তর্বিভাগে চিকিৎসাধীন রোগীদের কপালে থাকা খাওয়া আর ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কিছুই জোটেনা।  অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকার পরও পরীক্ষা-নীরিক্ষা ওষুধ সবই করতে হয় বাইরে।ডাকলেও ডাক্তার আসেনা।  পদে পদে বকশিস আর নোংরা পরিবেশের কারণে দুর্ভোগে রোগীরা।  পাশাপাশি আয়া, ব্রাদার, নার্সদের দুর্ব্যবহারতো রয়েছেই।  প্রতিদিনই দালালদের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন এখানকার অনেক রোগী।সদর উপজেলার চর করমজী গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্রী তানজিলা (১৩)।  বুধবার দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যান।  তানজিলার বাবা লতিফ খান মেয়ের চিকিৎসার জন্য দ্রুত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) ভর্তি করেন।জরুরি বিভাগ থেকে মহিলা মেডিসিন বিভাগে পাঠানো হয় তাকে। তানজিলার চাচা আনিসুর রহমান জানান, বুধবার বিকেল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত তারা ডাক্তারের দেখা পাননি।  ওয়ার্ডে নোংরা পরিবেশ শৌচাগারগুলোতে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি জমে রয়েছে।  তা ব্যবহার করে তার ভাতিজি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে।  মহিলা মেডিসিন থেকে পুরুষ সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। সদর উপজেলার চরমোনাই এলাকার বাবুল সিকদারের ছেলে আরাফাত (২৫) প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে।  ভর্তির পর দু’দিন পেরিয়ে গেলেও ইন্টার্ন করা শিক্ষার্থীরা ছাড়া চিকিৎসকের দেখা পাননি তিনি।  হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। তার পাশের রোগী নগরীর রূপাতলী এলাকার বাসিন্দা মো. ইউনুস (৪০)।  সিড়িতে পড়ে মাথায় আঘাত নিয়ে বুধবার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।রাতে হাসপাতালের চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাকে সিটিস্ক্যান করাতে বলেন।  মেডিকেলের মেশিন ভালো নয়, লাইফ সিটি স্ক্যান সেন্টার নামে একটি প্রাইভেট প্যাথলজি ক্লিনিকের নাম লিখে দেন তিনি।  মো. ইউনুস রাতেই সিটিস্ক্যান করান।  সকালে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নার্সকে রিপোর্ট দেখাতে গিয়ে জানতে পারেন রাতের ওই ব্যক্তি চিকিৎসক নয়, তিনি দালালদের খপ্পরে পড়েছিলেন।হার্নিয়া সমস্যা নিয়ে ৪ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হন সদর উপজেলার চরবাড়িয়া এলাকার বৃদ্ধ আজিজুল হক (৭৫)।তার অপারেশন করা হয়।তবে বৃদ্ধ আজিজুল হকের সেলাই ক্ষত সেরে ওঠার আগেই বৃহস্পতিবার ছাড়পত্র দেয়া হয় সার্জারি বিভাগ থেকে।বিপাকে পড়তে হয় বৃদ্ধ আজিজুল হককে।  ইনফেকশন সংক্রামনের শঙ্কা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন বৃদ্ধ আজিজুল। রোগীদের এসব অভিযোগ নতুন নয় উল্লেখ করে টিআইবির আদলে গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশালের সভাপতি প্রফেসর এম. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, সরকারিভাবে সব ধরনের বরাদ্দ থাকার পরও শুধুমাত্র স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার অভাবে এখানে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি।এতে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।নিজ নিজ বিবেক জাগ্রত না হলে যত মেশিনারিজ আর অর্থ বরাদ্দ দেয়া হোক না কেন এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।অবশ্য সকল অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অস্বীকার করে শের-ই- বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মু. কামরুল হাসান সেলিম জাগো নিউজকে জানান, কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিস্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাই কারো কোনো অভিযোগ থাকলে তাকে জানাতে বলেন তিনি। ওষুধ সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওষুধের বড় একটি সাপ্লাই এসেছে।  শনিবার থেকে ওষুধ সংকট কেটে যাবে।পরীক্ষা-নীরিক্ষার বিষয়ে বলেন, মেডিকেল থাকতে লোকজন কেন বাইরে থেকে টেস্ট করাবে।এটা তারও বোধগম্য নয়।পরিচালক ডা. মু. কামরুল হাসান দালাল নির্মূলের পরিকল্পনা তুলে ধরে বলেন, সবাইকে ড্রেস কোড মেনে চলতে হবে।সবার জন্য আইডি কার্ড নিশ্চিত করা হবে।  যারা রোগীর সঙ্গে আসবেন তাদের দর্শনার্থী কার্ড থাকবে।তখন আমরা বাইরের কাউকে পেলে চ্যালেঞ্জ করবো। এজন্য আমাদের নিয়মিত ভিজিল্যান্স টিম থাকবে।প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেবো।এমএএস/এমএস

Advertisement