ওয়ানডে সিরিজ ছিলো ‘পঞ্চপাণ্ডব’ময়। ফ্যান্টাস্টিক ফাইভের ডানায় চড়েই এক দিনের সিরিজে সাফল্যের চূড়ায় আরোহন করেছিল টাইগাররা। তিন ম্যাচের প্রথমটিতে পঞ্চপান্ডবের দুই বাঁহাতি তামিম-সাকিব হয়েছিলেন আলোকবর্তিকা। প্রথম ওভারে উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পরে দুই বাঁহাতির ২০৭ রানের জুটিতে ভর করে গড়ে উঠেছিল টাইগারদের জয়ের বীজ।
Advertisement
দ্বিতীয় ম্যাচে জয়ের দোড়গোড়ায় গিয়ে ছুঁতে না পারলেও তামিম-সাকিবের ৯৭ রানের আরেক বড় জুটি আশা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে আবারো তামিম-সাকিব জুটির কার্যকরী ব্যাটিং। এবার সেন্ট কিটসে ৮১ রানের জুটি এবং তাতেই সিরিজ জয়ের পথে এগিয়ে যাওয়া।
আজ কাঁকডাকা ভোরে তামিম-সাকিবের চওড়া ব্যাটে স্কোরবোর্ড হলো মোটাতাজা, লম্বাচওড়া। তবে এবার আর দ্বিতীয় উইকেটে নয়, চতুর্থ উইকেটে। ৭.৪ ওভারে ৩ রান তখন ৪৮। এই ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে ৫০ বলে ৯০ রানের ম্যাচ নির্ধারণী জুটি। যার উপরে ভর মেলে ১৭১ রানের বড় পুঁজি। তামিমের ব্যাট থেকে আসে ৭৪, সাকিব করেন ৬০।
সাকিব-তামিমের এই কার্যকরী জুটি বাদ দিয়ে এই দুজনের ব্যক্তিগত অবদান দেখলেও অনেক এগিয়ে থাকবেন তারা। বাংলাদেশ দলের মোট ১৭১ রানের মধ্যে ১৩৪ রানই এসেছে এই দুয়ের ব্যাটে। অতিরিক্ত খাত থেকে ৪ রান বাদ দিলে বাকিরা করেছেন মাত্র ৩৩ রান। পরে বল হাতেও কিপটে বোলিংয়ে ২ উইকেট নিয়েছেন সাকিব।
Advertisement
বাংলাদেশ দল গত দুই বছরে যে চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জিতেছেন সেসব ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়েছেন পঞ্চপান্ডবের চারজন। গতবছরের এপ্রিলে শ্রীলংকার বিপক্ষে সাকিব আল হাসান ও আজ (রোববার) ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তামিম ইকবাল। মাঝে নিদাহাস ট্রফির দুই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিম। পঞ্চপান্ডবের শীর্ষ পান্ডব মাশরাফি বিন মর্তুজার পক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচসেরা হওয়া সম্ভব নয়। কেননা অদৃশ্য কালো হাতের স্পর্শে যে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক এখন শুধুই ওয়ানডে দলের অধিনায়ক।
উপরে বলা হয়েছে তামিম-সাকিব জুটির সাতকাহন। তবে আজকের পার্টনারশিপটি যে নতুন কাহিনীতে সাজানো। আজকাল তামিম খেলছেন ধীরে-সুস্থে, আক্রমণাত্মক মেজাজের বদলে রয়ে-সয়ে; প্রতিপক্ষ বোলিংকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার চেয়ে নিজ দলের ইনিংসকে লম্বাচওড়া করার কথা ভেবে। তাই ক্যারিয়ার শুরুর সময়ের তুখোড় মারকুটে ওপেনার তামিম ইকবালের ব্যাট এখন অনেকটাই শান্ত।
তামিম এখন শট খেলার চেয়ে উইকেটে টিকে থাকতেই বেশি উৎসাহী। তাই স্ট্রাইকরেট গেছে কমে। ওয়ানডে সিরিজে যা ছিলো ৭৭ এর আশেপাশে। আজ টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তামিম যেন ফিরে গেলেন ক্যারিয়ারের স্বর্ণ সময়ে। খেললেন ৪৪ বলে ৭৪ রানের ইনিংস। স্ট্রাইকরেট ওয়ানডের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি, ১৬৮।
তামিম দেখিয়ে দিলেন আমি এখনো আগের মতোই মারতে পারি, চার-ছক্কার ফুকঝুরি ছোটাতেও পারি। তা যে পারেন তার জ্বলন্ত নজির আজকের ম্যাচে সাকিবের(১৫৭) চেয়ে বেশি স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং। তামিমের এই ঝড়ো উইলোবাজি কাজে দিতো যদি বন্ধু সাকিব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিতেন। লিটন (১), মুশফিক (৪) ও সৌম্য (১৪) অল্পতেই ফিরে যাওয়ার পর তামিম-সাকিব হাত খুলে খেলে ক্যারিবীয় বোলারদের আর চেপে বসার সুযোগ দেননি। ওই সময়ে জুটি গড়ার পাশাপাশি হাত খুলে খেলাও যে খুব জরুরী ছিল। নাহয় ওভারপ্রতি রান তোলার গতি কমে যেত অনেক।
Advertisement
‘আমাদের পরে সে অর্থে রিয়াদ ভাই ছাড়া আর কেউ ভরসা করার মতো কেউ নেই। বিগহিট খেলার সামর্থ্যও কম। তাই যা করার আমাদেরকেই করে যেতে হবে’ – এই বোধ উপলব্ধি থেকেই দুজনের এমন ঝড়ো ব্যাটিং। এইযে সঠিক সময়ে সঠিক উপলব্ধি এবং সেই মতো কাজ করা, সেখানেই তামিম-সাকিবের বিশেষত্ব।
আজকের ম্যাচের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে সেটাই বেরিয়ে আসবে। শেষপর্যন্ত সাকিব, মোস্তাফিজ, নাজমুল অপু, আবু হায়দার ও রুবেল হোসেনের কার্যকর বোলিংয়ে ১২ রানের জয় ধরা দিলেও, এ জয়ের সত্যিকারের রুপকার-স্থপতি যে সাকিব-তামিমই।
আর তাই তো শেষ ওভারে নাজমুল অপুর দুই রান দিয়ে দুই উইকেট, সাকিবের দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্স (৬০ ও ২ উইকেট) সত্ত্বেও তামিম ইকবালই হয়েছেন ম্যাচ সেরা। বুঝাই গেছে তামিমের ইনিংসটাকেই ম্যাচ ভাগ্য নির্ধারণী ইনিংস হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
অবশ্য এখানে সাকিবের অবদানও কিছু কম নয়। বরং বোলিংটাকে মানদণ্ড ধরলে ম্যাচসেরার অন্যতম দাবিদার যে সাকিবও। দুই বন্ধুর দুজনই যৌথভাবে ম্যাচসেরা হননি। তামিমের হাতেই উঠেছে ম্যাচসেরার পুরষ্কার- তাতে কি! শেষ হাসি তো অধিনায়ক সাকিব আল হাসানেরই। সাকিব-তামিম হাসলে যে বাংলাদেশও হাসে সে সত্য জানা হলো আরেকবার।
এআরবি/এসএএস/এমএস