স্মৃতি। শব্দ। ঘটনা। এই তিনের মধ্যেই তাঁর আটানব্বই বছরের অসমাপ্ত জীবন! আর সশরীরের জীবন? তার দৈর্ঘ্য মাত্র ৫৫ বছর! কিন্তু সেই জীবনও ছিল মধ্যবিত্ত এক পবিরবারে জন্ম নেয়া শিশু থেকে কিশোর। তারুণ্য আর যৌবন কেটেছিল যার জেলে।
Advertisement
যিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন মিছিলে যোগ দিয়েছেন। রাজপথে শ্লোগান দিয়েছেন। কিন্তু মানচিত্রে সীমানা আাঁকা সেই স্বাধীনতা তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশ নয়। সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। তাই নিজেই আন্দোলন, সংগ্রাম-জেল-ঝুলুম, অত্যাচার –নির্যাতন সহ্য করে পূর্ব বাংলার এই ভূখণ্ডের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
বুঝাতে পেরেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা অলিক-অবাস্তব-অকল্পনীয় কোন স্বপ্ন নয়। এদেশের কৃষক-শ্রমিক,ছাত্র-যুবক, সাধারণ মানুষ তার এই দর্শনে বিশ্বাস রেখেছিলেন। তাই এই পূর্ব বাংলায় উন্নসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ নামক একটা দেশের জন্ম হয়েছে। মুক্ত স্বাধীন স্বদেশে তিনি যুবক, তরুণদের নিয়ে নতুন স্বপ্নের জয়গান গাইতে শুরু করলেন।
যেখানে বিপ্লবের শ্লোগান নয়। প্রতিবিপ্লবের হুঙ্কার নয়। ছিল নতুনের আহ্বান। তিনি চেয়েছিলেন এইদেশে আলোয়-আলোয়, ধুলোয়-ধুলোয়, ঘাসে-ঘাসে বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক, মুক্তি। তাঁর ভেতর ছিল না কোন বিশ্বাসহীনতা। তাই তাঁর বিশ্বাস আজও স্মৃতির মনুমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই দেশ। কিন্তু সেই দেশেই আবার আজ মনে হয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর স্বপ্নের অনেক কিছু যেন জাদুঘরমুখি!
Advertisement
যে কারণে আলোয়-আলোয়, ধুলোয়-ধুলোয়, ঘাসে-ঘাসে তার স্বপ্ন দেখা তারুণ্যের মুক্তি মেলেনি! বরং সাতচল্লিশ বছর বয়সী বাংলাদেশে তারুণ্য আজ হতাশাগ্রস্থ। বিপন্ন। যে কারণে সেই হতাশা আর বিপন্নতা কাটাতে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলতে হয়; বিপদগামী তারুণ্যকে পথে ফেরাতে ‘মাদক’-কে ‘না’ বলুন! তাতেও কাজ হয় না। তাই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে ‘ক্রস ফায়ার’-র শব্দে ঘুম ভাঙে বাংলাদেশের!
আবার ঘুম থেকে জেগে ওঠা বাংলাদেশের অন্য চেহারাও দেখলো বিশ্ব। তারুণ্যের আন্দোলনে নয়। কোটা বিরোধী অন্দোলনে নয়। যাদের শরীরে, মনে এখনও তারুণ্যের ছোঁয়া লাগেনি। যারা কিশোর। তারা স্কুলব্যাগ পিঠে নিয়ে আর বাসের চাকায় পিষ্ট হতে চায় না।
দেখতে চায় না বাস-ট্রাক অকালে কেড়ে নিচ্ছে আর কোন মানুষের প্রাণ। নিজেদের সামান্য এই চাওয়ার কথা বলতে গিয়ে ওরা দেখিয়ে দিল সাতচল্লিশ বছরের বাংলাদেশে রাষ্ট্র যন্ত্র, সমাজ সব জায়গায় কি পরিমান ঘুণে ধরেছে! যেখানে মন্ত্রী শপথ বাক্য ভুলে জড়িয়ে পড়েন স্বার্থ -সংঘাতে। যেখানে বিচারপতি চলেন লাইন্সেসহীন ড্রাইভারের গাড়ীতে। যেখানে পতাকা উড়ানো গাড়ী চলে রাস্তার উল্টো পথে!
ট্রাফিক আইন ঠিক রাখতে যারা পুলিশের পোশাক পরে সারা শহর মোটর সাইকেলে, গাড়ীতে চষে বেড়ান, তাদের অনেকের গাড়ীর লাইসেন্স নেই। অনেকের ফিটনেস সার্টিফিকেট মেয়াদ উত্তীর্ণ! স্কুল পড়ুয়া ছাত্ররা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, আর যাই হোক এটা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ না। এটা লাখ শহীদের রক্তে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের মুখ নয়, হতে পারে না!
Advertisement
বাঙালির শোকের মাস আগস্টে সহপাঠী হারানো কিশোর-কিশোরীরা বার বার যেন ফিরিয়ে আনতে চাইলো বঙ্গবন্ধুকে।‘ যেখানে অন্যায় দেখবে, সেখানেই প্রতিবাদ করবে। রুখে দাঁড়াবে।’ অন্য কারো কথা নয়। জাতির জনকের কথা। ওরা রুখে দাঁড়ায়। ওরা স্বপ্ন দেখায়। ওদের হাতের প্লেকার্ড বলে দেয়, ওরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ নির্মাণের ব্রতচারী।
ওরা পথচারী হয়ে আর বাস-ট্রাক নামক দানবের চাকায় পিষ্ট হতে চায় না। রাজপথে এই কিশোরদের প্রতিবাদকে যদি কেউ বিপ্লব মনে করেন তিনি ভুল। যদি কেউর ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজেন তিনিও ভুল। যদি কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা খোঁজেন তিনি ভুল। কারণ, ওরা ওদের আগের কয়েকটা প্রজন্মকে দেখেছে। যারা, মুখে আর্দশ আর স্বপ্নের ফেরিওয়ালা! কিন্তু বাস্তবে কাবুলিওয়ালার মত মুনাফা খোঁজেন। সেটা বাসে-ট্রাকে-লঞ্চে-নদীতে-রাস্তায়, পথে-ঘাটে সব জায়গায়। কিন্তু এ কিশোররা তাই রাস্তায় নেমে আইন হাতে তুলে নেয়নি। আইনের অক্ষরগুলো এই সমাজের অন্ধমানুষগুলোকে পড়িয়ে দিলেন।
এরা কেউ বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে, ওদের সামনে প্রতিমুহুর্তে বঙ্গবন্ধু এসে দাঁড়িয়ে যান। শুনিয়ে যান তাঁর সব অমর বাক্য। মুজিব কোট পরা মানুষগুলো শুধু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাকি জীবনের কথায়, জীবনযাত্রায়, চর্চায় ওরা বঙ্গবন্ধুকে খুঁজতে চান না। বুঝতে চান না। তাই এই কিশোররা রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে শৃঙ্খলা কতটা জরুরি।
অল্প সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন;‘ মনে রেখো, শাসন করা তারাই সাজে সোহাগ করে যে। তুমি যখন শাসন করবা, সোহাগ করতে শেখো। তাদের দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়িও। তাদের ভালবাস। কারণ, তোমার হুকুমে সে জীবন দিবে। তোমাকে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। সে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে তোমাকে শৃঙ্খলা শিখতে হবে। নিজেকে সৎ হতে হবে। নিজেকে, দেশকে ভালবাসতে শিখতে হবে। এবং চরিত্র ঠিক রাখতে হবে।. .....। মনে রেখো, ‘মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’ এই কিশোররা রাস্তপথে শৃঙ্খলা কী জিনিস সেটা শিখিয়ে দিলো। কিন্তু আমরা কী শিখলাম? আমাদের মন্ত্রী, এমপি,আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পেশাজীবী সবাই ওদের পাশে দাঁড়ালাম। কিন্তু কতটুকু শুদ্ধচিত্তে। কতটুকু সুস্থ চিন্তা থেকে!
ভবিষৎ জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চিয়তা, হতাশা সঙ্গী তারুণ্য, অনেক কিছুর নিশ্চয়তা খুঁজতে বেছে নেয় রাজপথ। আর কিশোর-কিশোররীরা রাজপথে স্কুল-কলেজের বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা সতীর্থদের হারিয়ে ফেঁটে পড়ে ক্ষোভে। শোকে-ক্ষোভে বিক্ষুব্ধ মননেও তারা প্লেকার্ড, পোস্টার উচিয়ে ধরতে পারে; ‘ যদি ভয় পাও তুমি শেষ। যদি রুখে দাঁড়াও তবে তুমিই বাংলাদেশ।’ রুখে দাঁড়াতে না পারলে শেষ বাংলাদেশও!
তারা রুখে দাঁড়াতে চায়। সেটা শুধু একজন মন্ত্রী, একজন বাস মালিক, একজন ড্রাইভার, একজন হেলপারের বিরুদ্ধে নয়। তারা রুখে দাঁড়াতে চায় লুট-পাট,অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে। শুধু রাজপথে স্বাভাবিক চলাচলের গ্যারান্টি নয়। জীবনে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিও চায় তারা। বাসের চাকায় পিষ্ট হতে চায় না কোন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। পুলিশের বুটের তলায়ও তারা পিষ্ট হতে চায় না। কারণ, সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় পুলিশের বেতন দেয়া হয়। তাদের অস্ত্র কেনা হয়।
গাড়ী কেনা হয়। সেটা কোন মন্ত্রী, মালিকদের ঘাতক বাস পাহারা দেয়ার জন্য নয়। তরুণ, কিশোরদের রাষ্ট্রের পুলিশের মুখোমুখি দাঁড় করাতে বঙ্গবন্ধু এই দেশটার স্মৃষ্টি করেননি। বাংলাদেশের জন্মকথায় বরং উল্টোটাই লেখা আছে। বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। প্রতিবাদ করতে বলেছেন। সুশৃঙ্খলভাবে কিশোররা রুখে দাঁড়িয়েছে। এখন সময় আমাদের। ওদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণের। সেই সংবেদনশীলতার অভাব হলেই বিপদ।
কথায় ক্ষমতার ঝংকার থাকলে বিপদ। অনেকের কণ্ঠস্বরে ক্ষমতার ঝংকার। হুঙ্কার। আবার কেউ কেউ আছেন যাদের ক্ষমতা নেই। কথায় হুঙ্কার নেই। কিন্তু আছে স্বপ্নের ফাঁফা বেলুনের মধ্যে বসবাস। তাই তাঁরা কিশোরদের নিরাপদ সড়কের দাবির মধ্যেও রাজনীতির বিপজ্জনক গন্ধ খুঁজে বেড়ান। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপদ সড়কের দাবিকে সংবেদনশীলতা দিয়ে বিবেচনা না করে রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতায় আটকে থাকতে চাইছেন। আবার কেউ রাজনৈতিক সংকট তৈরির স্বপ্ন দেখছেন।
সংকটটা আসলে যান্ত্রিক। কিন্তু সমাধনে হতে হবে মানবিক। যান্ত্রিক আর মানবিক এই দ্বন্দ্বের মাঝে রাজনীতি না খোঁজা ভাল। বঙ্গবন্ধু আপদমস্তক রাজনীতিবিদ। কিন্তু তিনি ছিলেন মানবিক। বিশ্ব মানবতা লুণ্ঠিত হতে দেখলে তিনি ছিলেন নির্ভীক। শান্তির বার্তা ছড়াতে তিনি ছিলেন বিশ্ব নাগরিক। তাঁর সৃষ্ট দেশে রাজপথে যান্ত্রিক অশান্তির বাতাবরণ, রাষ্ট্র যন্ত্রে অসুখের লক্ষণ। এক কবির কথা ধার করে, গোটা কয়েক শব্দ রদবদল করে লিখতে হচ্ছে;‘ আমার ঢাকার মন ভাল নেই। বৃষ্টির স্পন্দন উধাও কবেই। আমার শহরটার বড্ড অসুখ। তেষ্টায় তেষ্টায় শ্রাবণ উন্মুখ।’
শুধু ঢাকা নয়। আমাদের দেশটারই বড্ড অসুখ। রোজ খবরের কাগজের পাতায়, ফেসবুকের ওয়ালে, টেলিভিশনের পর্দায় সব জায়গায় মন খারাপের খবর! আর আগস্ট আসলে মনটাতো এমনিতেই খারাপ হয়ে যায়। শোকের মাসে বাঙালি আর কত শোকের খবর পড়বে। দেখবে। শুনবে! আমাদের জীবনের রিংটোনটা-ই কী শোকের মিউজিক হয়ে বাজবে! এই রিংটোন কবে বদলাতে পারবো?
শ্রাবণের এই বৃষ্টিভেজা সকাল, মেঘলা দুপুর, নাগরিক বিষন্নতা, এর মাঝে রাজপথে কিশোর বিপ্লব! বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কি বলতেন জানি না। কিন্তু তাঁর স্নেহধন্য অনেকের মুখে শুনছি বঙ্গবন্ধুর গাড়ীর সামনে ওরা দাঁড়ালে বলতেন, ‘ কি চাস তোরা?’ শুনতেন। তারপর হয়তো ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে, দু’ একজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন; ‘ যা ক্লাসে ফিরে যা, আমি ওমুককে বলে দিচ্ছি।’ কিন্তু তিনি যে নেই। সেভাবে ওটা বলার মতও কেউ নেই।
বঙ্গবন্ধু নেই। আবার তিনি আছেন। এই ডিজিটাল বাংলায় তিনি আছেন। অনেকের স্মৃতিতে। অনেকের বিশ্বাসে। অনেকের আদর্শে। তাই ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু আর্কাইভ থেকে তিনি ভেসে ওঠেন। শুনিয়ে যান অনেকে কথা। অন্যরা শোনেন। কিন্তু শুনতে পান না শুধু তাঁর দলের কিছু লোক। কিছু মন্ত্রী! তাদের মুখে কথার খই ফোটে। কারণ, ওরা মন থেকেই অনেক আগে বঙ্গবন্ধুকে হয়তো ‘ডিলিট’ করে দিয়েছেন। অথবা দিয়েছিলেন।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস